ড. মতিউর রহমান : বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্রম পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা আপাতদৃষ্টিতে নীরব হলেও অত্যন্ত রূপান্তরমূলক। শহরের ব্যস্ত রাস্তা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত, স্মার্টফোনের মাধ্যমে কাজের এক নতুন ধারার সূচনা হয়েছে। উবার, পাঠাও-এর মতো রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম অথবা চালডাল এবং ফুডপান্ডার মতো অনলাইন ডেলিভারি পরিষেবাগুলো দেশের শ্রমবাজারে এক নতুন অধ্যায়ের জš§ দিয়েছে। এর পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিংয়ের দ্রুত প্রসার একটি ডিজিটাল গিগ অর্থনীতি তৈরি করেছে, যা কর্মীদের স্বাধীনতা, কাজের নমনীয়তা এবং উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে।
লাখ লাখ বাংলাদেশি, বিশেষ করে তরুণ প্রজš§, নারী এবং যারা এত দিন আনুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান থেকে দূরে ছিল, তাদের জন্য এই গিগ অর্থনীতি আর্থিক স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভর কাজের একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। তবে এই স্বাধীনতার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক জটিল বাস্তবতা। প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ এবং গিগ অর্থনীতিবিষয়ক বিভিন্ন তত্ত্ব (যেমন শ্রনিসেকের ‘প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজম’ এবং ডি স্টেফানোর বিশ্লেষণ) এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, ডিজিটাল স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি অনেক সময়ই শোষণ এবং আয়ের অনিশ্চয়তাকে আড়াল করে রাখে। এই বৈপরীত্য উপলব্ধি করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির দ্রুত প্রসার ঘটছে, যা দেশের ডিজিটাল শ্রমবাজারকে বদলে দিচ্ছে। বর্তমানে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার এই খাতে কাজ করছেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্মগুলোও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু ঢাকা মহানগরেই হাজার হাজার মানুষ রাইড-শেয়ারিংয়ে যুক্ত। উবার-এর এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তাদের ড্রাইভার-পার্টনাররা অন্যান্য বিকল্প কাজের চেয়ে গড়ে ৪২ শতাংশ বেশি উপার্জন করেন। ২০২৪ সালে উবারের অর্থনৈতিক প্রভাব প্রায় ৫৫ বিলিয়ন টাকা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের এক অনুমান অনুযায়ী, গিগ অর্থনীতি বাংলাদেশের জিডিপিতে যে অবদান রাখছে, তা ২০২০ সালের ৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হতে পারে। ২০২০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১ হাজারেরও বেশি নতুন গিগ প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যা দেশের ডিজিটাল অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকেই তুলে ধরে।
পরিমাণগত বৃদ্ধি গিগ অর্থনীতির একটি দিকমাত্র। নিক শ্রনিসেকের ‘প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ’ ধারণাটি এই অর্থনীতির মূল কাঠামোকে তুলে ধরে। প্ল্যাটফর্মগুলো মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে, যেখানে ডিজিটাল বাস্তুতন্ত্রের মাধ্যমে পরিষেবা প্রদানকারী, ভোক্তা এবং বিজ্ঞাপনদাতারা যুক্ত হন। এরা নেটওয়ার্ক প্রভাবের মাধ্যমে দ্রুত প্রসারিত হয় এবং ব্যবহারকারীদের থেকে ডেটা সংগ্রহ ও তাদের মিথস্ক্রিয়াকে ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন করে।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই প্ল্যাটফর্মগুলো বাজার এবং এর মূল্য প্রবাহের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ রাখে। ফলে গিগকর্মীদের জন্য এক ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়: যেখানে স্বাধীনভাবে কাজ করার স্বাধীনতা বলে মনে হয়, তা আসলে প্ল্যাটফর্মের অস্বচ্ছ অ্যালগরিদম, পারফরম্যান্স রেটিং এবং পরিবর্তনশীল নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কর্মীরা প্ল্যাটফর্মের শাসনের অধীন থাকে এবং কাজ, উপার্জন ও দৃশ্যমানতার জন্য এর ওপর নির্ভরশীল।
কার্যত, এই স্বায়ত্তশাসন একটি মরীচিকা ছাড়া আর কিছু নয়। এটি প্ল্যাটফর্মের মালিক ও ডিজিটাল কর্মীদের মধ্যে থাকা কাঠামোগত ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতাকে আড়াল করার জন্য তৈরি করা একটি চতুর কৌশল।
ডি স্টেফানোর বিশ্লেষণ গিগ অর্থনীতির কাঠামোর গভীরে প্রবেশ করে, বিশেষ করে ‘সঠিক সময়ে কর্মী নিয়োগ’ (লঁংঃ রহ ঃরসব ষধনড়ৎ) মডেলের ওপর জোর দেয়। এই মডেলের অধীনে, গিগকর্মীরা অ্যালগরিদমিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজ করে, যাদের জন্য ন্যূনতম শ্রম সুরক্ষা ও নিরন্তর অনিশ্চয়তা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশে অধিকাংশ গিগকর্মীকে স্বাধীন ঠিকাদার (রহফবঢ়বহফবহঃ পড়হঃৎধপঃড়ৎং) হিসেবে ধরা হয়। ফলে সরঞ্জাম, পরিবহন এবং কাজের বিরতির সময়কালসহ যাবতীয় আর্থিক ঝুঁকির দায় তাদেরই নিতে হয়। প্রচলিত কর্মসংস্থান সুবিধা যেমনÑস্বাস্থ্যসেবা, পেনশন বা সবেতন ছুটিÑএসব থেকে তারা সম্পূর্ণ বঞ্চিত। তাদের আয়ের পরিমাণ অত্যন্ত অস্থির ও অনিশ্চিত; কাজের সহজলভ্যতা ও উপার্জন অপ্রত্যাশিতভাবে ওঠানামা করে, যা বিশেষ করে তরুণ ও প্রান্তিক কর্মীদের মধ্যে তীব্র আর্থিক অস্থিরতা তৈরি করে।
এই ব্যবস্থায় ক্যারিয়ারের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। কারণ প্ল্যাটফর্মগুলো দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ বা পদোন্নতির খুব কম সুযোগ দেয়। এটি স্বল্প মজুরি ও অনিশ্চিত শ্রমের একটি চক্রকে আরও শক্তিশালী করে। অ্যালগরিদমিক ব্যবস্থার ক্রমাগত নজরদারি এবং কর্মীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা মানসিক চাপকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে, যা তাদের পেশাগত জীবনে আরেকটি নতুন মাত্রার অনিশ্চয়তা যোগ করে।
বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে গিগ অর্থনীতির উত্থান এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে। দেশের প্রায় ৮৫ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপ) ৪৩ শতাংশ জোগান দেয়। এমন অবস্থায় অনেক কর্মীর জন্য গিগ কাজ পূর্বের অনিশ্চিত কর্মসংস্থান থেকে আরেক ধরনের অরক্ষিত ডিজিটাল শ্রমে রূপান্তরের মতো।
গিগ কাজের মাধ্যমে নারীরা আর্থিক স্বাধীনতা পেলেও, তাদের আয়ের সম্ভাবনা প্রায়ই কাঠামোগত বৈষম্য এবং অ্যালগরিদমের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে সীমিত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে তরুণ প্রজš§ যারা পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন গিগ কাজ করে, তারা অনিয়মিত সময়সূচি ও আয়ের ওঠানামার মতো সমস্যার মুখোমুখি হয়; যা তাদের ভবিষ্যৎ কর্মজীবনের পরিকল্পনাকে বাধাগ্রস্ত করে।
গিগ অর্থনীতির অন্যতম আকর্ষণ হলো স্বায়ত্তশাসন ও স্ব-নির্দেশনার প্রতিশ্রুতি। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অনেক ক্ষেত্রে এই প্রতিশ্রুতি পূরণ হয় না। এর ফলে কর্মীরা স্থিতিশীল জীবিকা বা কর্মক্ষেত্রে মর্যাদা পাওয়ার পরিবর্তে ডিজিটাল অনিশ্চয়তার দুষ্টচক্রে আটকা পড়েন।
গিগ অর্থনীতি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। যদি এটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে এটি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পাশাপাশি শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়াতে সক্ষম। এছাড়া এটি দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনীয় ডিজিটাল দক্ষতা তৈরিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হলে প্রয়োজন সুচিন্তিত নীতি এবং কার্যকর নিয়ন্ত্রণ। গিগকর্মীদের জন্য আনুষ্ঠানিক সুরক্ষার পাশাপাশি ডিজিটাল কাজের উপযোগী দক্ষতা উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। আইনি কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা উচিত যেন তা স্বাধীন ডিজিটাল কর্মীদের অধিকার রক্ষা করে এবং প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে। এর মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তি, ন্যায্য পারিশ্রমিক এবং সম্মিলিত দর কষাকষির অধিকার অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন।
সার্নিসেকের পরামর্শ অনুযায়ী, সরকারি বা সমবায় মালিকানাধীন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো প্ল্যাটফর্মের একচেটিয়া আধিপত্য কমাতে পারে। এতে ডিজিটাল বাজার থেকে অর্জিত সম্পদ আরও সমানভাবে বণ্টন করা সম্ভব হবে। কর্মী, নীতিনির্ধারক, প্ল্যাটফর্ম পরিচালনাকারী এবং সুশীল সমাজের সমন্বিত আলোচনার মাধ্যমে এই পদক্ষেপগুলো একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ন্যায্য গিগ অর্থনীতি গঠনে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতি আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে এক গভীর প্রভাব ফেলছে। এটি কেবল চাকরির বাজারকে নতুন রূপ দেয় না, বরং আমাদের সামাজিক শ্রেণি বিভাগ, নারী-পুরুষের সম্পর্ক এবং তরুণদের ভবিষ্যৎ ভাবনার ওপরও পরিবর্তন নিয়ে আসে।
তরুণ প্রজšে§র কাছে অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং প্ল্যাটফর্মগুলো স্বাধীনতা, নতুন দক্ষতা অর্জন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার এক দারুণ সুযোগ এনে দেয়। তবে আয়ের অনিশ্চয়তা এবং তীব্র প্রতিযোগিতা তাদের এই স্বপ্ন পূরণের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
একইভাবে, যে নারীরা গিগ অর্থনীতিতে কাজ করছেন, তাদের অনেক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়। একদিকে তাদের যেমন ঘরের কাজ ও বাইরের দায়িত্ব সামলাতে হয়, তেমনি অ্যালগরিদমের পক্ষপাতমূলক আচরণের সঙ্গেও লড়াই করতে হয়। এই অ্যালগরিদমিক ব্যবস্থাপনা অনেক সময় বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তোলে, যা আপাতদৃষ্টিতে নমনীয় মনে হলেও কাঠামোগত বৈষম্য তৈরি করে।
বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির পরিবেশগত ও স্থানিক দিকগুলো এই খাতের চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। শহরাঞ্চলে যানজট, অপর্যাপ্ত গণপরিবহন এবং জ্বালানির উচ্চ মূল্য রাইড-শেয়ারিং ও ডেলিভারি সেবার অর্থনৈতিক কার্যকারিতাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এর ফলে চালক ও গ্রাহক উভয়কেই অতিরিক্ত পরিচালন ব্যয় বহন করতে হয়।
অন্যদিকে, গ্রামীণ ও আধা-শহুরে এলাকায় দুর্বল ইন্টারনেট সংযোগ, অবকাঠামোর অভাব এবং ডিজিটাল বৈষম্য গিগ অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের পথে বড় বাধা তৈরি করে। ফলে শহরের মানুষ অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা বেশি পায়, যা নগর ও গ্রামের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্যকে আরও গভীর করে।
স্মার্টফোন, স্থিতিশীল ইন্টারনেট এবং অ্যাপ ইন্টারফেসের মতো প্রযুক্তিগুলো গিগ অর্থনীতির ভিত্তি হলেও, এরাই সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতা উভয়ই তৈরি করে। এই প্রযুক্তি যাদের কাছে সহজলভ্য, তারা উপকৃত হয়, আর যাদের কাছে নয়, তারা সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
গিগ অর্থনীতি প্রচলিত শ্রম সুরক্ষার সীমাবদ্ধতাগুলো স্পষ্ট করে। ডিজিটাল শ্রমের বিকেন্দ্রীভূত এবং অ্যালগরিদমিক প্রকৃতির কারণে কর্মীদের অধিকার সুরক্ষার প্রচলিত পদ্ধতিগুলো যেমন ইউনিয়ন, আইনি সুরক্ষা এবং যৌথ দর কষাকষিÑএখানে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
গিগকর্মীদের সংগঠিত হওয়ার প্রচেষ্টা, তা ড্রাইভার অ্যাসোসিয়েশন, ফ্রিল্যান্স নেটওয়ার্ক বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মভিত্তিক সংগঠনের মাধ্যমেই হোক না কেন, প্রায়ই বড় বড় করপোরেট সংস্থার প্রতিরোধের মুখে পড়ে। এই সংস্থাগুলো দাবি করে যে এমন উদ্যোগ প্ল্যাটফর্মের নমনীয়তা এবং উদ্ভাবনের পথে বাধা সৃষ্টি করবে।
আইনি সুরক্ষার অভাবে গিগকর্মীরা অ্যালগরিদমের স্বেচ্ছাচারী পরিবর্তন, অ্যাকাউন্ট নিষ্ক্রিয়করণ অথবা বেতন কাঠামোর আকস্মিক পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকে। এটি উদ্ভাবন এবং শোষণের মধ্যে একটি অস্থিতিশীল ভারসাম্য তৈরি করে।
বাংলাদেশে, গিগ অর্থনীতি বাড়ছে, কিন্তু নীতিগত প্রতিক্রিয়া এখনও সীমিত। বর্তমান শ্রম আইনগুলো মূলত আনুষ্ঠানিক চাকরিজীবীদের জন্য তৈরি, তাই স্বাধীন ঠিকাদাররা অনেক ক্ষেত্রে আইনের সুরক্ষার বাইরে থেকে যান।
গিগকর্মীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে, স্বাস্থ্য বীমা, অবসরকালীন সুবিধা এবং দুর্ঘটনা কভারেজের মতো বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ। কিছু পাইলট প্রোগ্রাম চালু হয়েছে, যেমন ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি, আর্থিক সাক্ষরতা এবং সমবায় প্ল্যাটফর্ম মডেল, যা ভবিষ্যতে নীতি প্রণয়নে সহায়ক হতে পারে।
তবে এই উদ্যোগগুলো আরও বড় পরিসরে ছড়িয়ে দিতে হলে সরকার, বেসরকারি খাত এবং নাগরিক সমাজের মধ্যে সমন্বয় দরকার। যদি একটি সুসংগঠিত নীতি কাঠামো না থাকে, তাহলে গিগ কাজের আধুনিক রূপ অনানুষ্ঠানিক খাতের দুর্বলতাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
অর্থনৈতিক ও নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে দেখলে, বাংলাদেশে গিগিফিকেশন বেশ কিছু নীতিগত এবং সামাজিক প্রশ্ন তৈরি করছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো যেভাবে শ্রমবাজারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তাতে শ্রমের মর্যাদা, কাজের স্বাধীনতা এবং সামাজিক নিরাপত্তার প্রচলিত ধারণাগুলো হুমকিতে পড়েছে। গিগকর্মীরা নিজেদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেও, তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় যে তাদের এই স্বাধীনতা আসলে সীমিত।
কাজের সময়সূচি, দৃশ্যমানতা এবং উপার্জনের মতো বিষয়গুলো প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম দ্বারা পরিচালিত হয়। স্ব-কর্মসংস্থান এবং উদ্যোক্তা স্বাধীনতার ধারণাগুলো প্রায়ই প্রযুক্তিনির্ভরতার বাস্তবতাকে আড়াল করে রাখে। এ কারণেই এমন নীতি তৈরি করা আবশ্যক যা ন্যায্য শ্রম ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করবে এবং নিশ্চিত করবে যে প্রযুক্তির অগ্রগতি যেন সামাজিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থি না হয়।
বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতি বৈশ্বিক প্রবণতা এবং স্থানীয় বাস্তবতার এক দারুণ উদাহরণ। স্রনিসেক এবং ডি স্টেফানোর ধারণাগুলো পশ্চিমা প্রেক্ষাপটে তৈরি হলেও বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম পুঁজিবাদ স্থানীয় অনানুষ্ঠানিক শ্রম কাঠামো, লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য এবং তরুণদের কর্মসংস্থানের চাপকে কাজে লাগায়। এ বিষয়গুলো বুঝতে পারা নীতিগত সমাধান এবং শ্রম সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো একই সঙ্গে সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো একদিকে যেমন আয়ের নতুন পথ খুলে দিচ্ছে, তেমনি কাজের নমনীয়তা এনেছে যা আগে ভাবা যেত না। এর ফলে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
তবে এর আরেকটি দিকও আছে। এসব ডিজিটাল কাজের কাঠামো প্রচলিত চাকরির নিরাপত্তার বদলে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে। এখানে শ্রমিকের অধিকার এবং সুরক্ষা প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। ফলে একদিকে যেমন কাজের স্বাধীনতা আছে, অন্যদিকে বৈষম্য ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে চলেছে। ডিজিটাল শ্রম যেন সবার জন্য সম্মান, নিরাপত্তা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করে, সেই লক্ষ্যে শ্রমিক, নীতিনির্ধারক এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের এই দ্বৈততাকে ভালোভাবে বোঝা জরুরি।
বাংলাদেশের গিগ অর্থনীতির পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং এর ঝুঁকি কমাতে একটি সমন্বিত কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য। এর জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত, গিগকর্মীদের জন্য আইনি স্বীকৃতি, সামাজিক সুরক্ষা এবং স্বাধীনভাবে সংগঠিত হওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শহর ও গ্রামের কর্মীদের মধ্যে ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে ডিজিটাল সাক্ষরতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং একটি ন্যায্য ডিজিটাল অবকাঠামো তৈরি করা জরুরি। তৃতীয়ত, গিগ প্ল্যাটফর্মগুলোর একচেটিয়া আধিপত্য কমাতে সরকার বা সমবায়ের উদ্যোগে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে, যা কর্মীদের অর্থনৈতিক সুবিধা আরও ন্যায়সঙ্গতভাবে বণ্টন করবে। এই বহুমুখী পদক্ষেপগুলো জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করে বাংলাদেশ গিগ অর্থনীতির কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিকারের মধ্যে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা তৈরি করতে পারে।
বাংলাদেশে গিগ অর্থনীতির প্রসার কেবল অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়, এটি এক গভীর সামাজিক রূপান্তরও। এটি শ্রমের চিরায়ত ধারণাকে নতুন করে সাজাচ্ছে, যেখানে কাজ কীভাবে সংগঠিত হয়, এর মূল্য কীভাবে নির্ধারিত হয় এবং কর্মীরা কীভাবে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন, তার সবকিছুই নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
এই প্ল্যাটফর্মনির্ভর ভবিষ্যৎ আমাদের সামনে কিছু মৌলিক প্রশ্ন নিয়ে এসেছে: কর্মক্ষেত্রে ন্যায্যতা, কর্মীদের স্বায়ত্তশাসন এবং তাদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত হবে? তথাকথিত ‘স্বাধীনতার’ ধারণাটিকে তাই আরও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে এবং এমন বাস্তবসম্মত নীতি, অনুশীলন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করতে হবে; যা গিগকর্মীদের জন্য প্রকৃত সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
প্ল্যাটফর্মভিত্তিক পুঁজিবাদের কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং গিগ কাজের অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বগুলোকে সমাধান করার মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন একটি ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলতে পারে; যা কর্মীদের সত্যিকার অর্থে ক্ষমতায়ন করবে। এর লক্ষ্য শুধু বেঁচে থাকার উপায় তৈরি করা নয়, বরং এমন একটি টেকসই, মর্যাদাপূর্ণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা।
গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী

Discussion about this post