Print Date & Time : 27 August 2025 Wednesday 4:45 am

শ্রমবাজার বাড়াতে মধ্যপ্রাচ্যের  বাইরে নজর সরকারের

নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর লাখো মানুষ কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করছেন প্রায় ২৮ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক।

দেশভিত্তিক হিসাবে সর্বাধিক শ্রমিক রয়েছেন সৌদি আরবে, যেখানে সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। এর পরেই রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রায় চার লাখ বাংলাদেশি। ওমানের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি সংখ্যা প্রায় ছয় লাখ ৮০ হাজার, কাতারে চার লাখ, কুয়েতে তিন লাখ ৫০ হাজার, আর বাহরাইনে প্রায় এক লাখ ৮০ হাজার। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের এই ছয়টি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের পাশাপাশি মালয়েশিয়াতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শ্রমিক কাজ করছেন। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় আট লাখ বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন, যারা মূলত বাগান, নির্মাণ, উৎপাদন সেবা খাতে কাজ করেন। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মালয়েশিয়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার।

এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইউরোপের কয়েকটি দেশেও বাংলাদেশি শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে ইতালিতে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি, গ্রিসে এক লাখের বেশি, আর মাল্টা সাইপ্রাসে কয়েক হাজার শ্রমিক বৈধ ওয়ার্ক পারমিটে কাজ করছেন। তারা মূলত কৃষি, নির্মাণ, হোটেলরেস্তোরাঁ নানা ধরনের সেবা খাতে যুক্ত আছেন। তবে ইউরোপে যাওয়ার পথে অনেকেই অবৈধ রুট বা মানবপাচারের ঝুঁকিপূর্ণ পথ ব্যবহার করছেন, বিশেষ করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি গ্রিসে পৌঁছানোর ঘটনা নিয়মিত ঘটছে।

শ্রমবাজারের ধরন হিসেবে বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রমিকই যুক্ত হন অদক্ষ পেশায়। বিশেষ করে গৃহকর্মী, নির্মাণশ্রমিক, পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতাকর্মী, চালক, কারখানা শ্রমিক কৃষিশ্রমিকের কাজেই তাদের নিয়োগ বেশি। এদের অনেকে কাফালা পদ্ধতির অধীনে কাজ করেন, যেখানে পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা, অতিরিক্ত কাজের চাপ, বেতন বিলম্ব কিংবা অনিয়মিত প্রদান, স্বাস্থ্যসেবার সীমাবদ্ধতা ন্যূনতম আবাসন সুবিধার মতো সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে কর্মপরিবেশ অনেক ক্ষেত্রেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে চিহ্নিত হচ্ছে।

এক সৌদি আরব প্রবাসী বলেন, দালালের খপ্পরে পরে আমার জীবনটাই শেষ। সৌদি আরব যাওয়ার পর আমাকে তায়েফে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাজ দেয়ার কথা বলে রাখা হয় একটি সুরক্ষিত জায়গায়। প্রথমে বলা হয়েছিল, কাজ না পাওয়া পর্যন্ত থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা দালালরাই করবে। কিন্তু প্রথম ১৫ দিন তাকে খাবার দেয়া হতো এক বেলা। এরপর বলা হয় একটি ভালো কাজ আছে, কিন্তু সেজন্য এক লাখ টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। টাকা দিতে রাজি না থাকায় আমাকে কয়েক দিন খাবারই দেয়া হয়নি। এরপর দালালরা আমাকে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ দেয়। পরে জানতে পারি, আমাকে দুই হাজার রিয়ালে ওই রেস্তোরাঁর কাছে বিক্রি করা হয়েছে। আমাকে ওই রেস্তোরাঁয় প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। বেতন দেয়া হয় সামান্য।

প্রবাসীদের একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রতারণার শিকার কয়েকশ প্রবাসীকে মাস খানেক আগে তায়েফের একটি নির্জন পাহাড়ি এলাকায় একত্র করে দালালরা। এরপর ভালো কাজ পাইয়ে দেয়ার আশ্বাসে তাদের কাছে আবার টাকা দাবি করা হয়।

অন্যদিকে আমেরিকা আফ্রিকার শ্রমবাজারে বাংলাদেশের উপস্থিতি এখনো সীমিত। এসব অঞ্চলে শ্রমিক যাত্রার সুযোগ মূলত উচ্চদক্ষ শিক্ষিত পেশাজীবীদের জন্য খোলা। সাধারণ বা অদক্ষ শ্রমিকদের সেখানে যাওয়ার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। ফলে মধ্যপ্রাচ্য মালয়েশিয়াই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের প্রধান গন্তব্য হিসেবে টিকে আছে। তবে কিছুদিন আগে উপদেষ্টা অধ্যাপক . আসিফ নজরুল মধ্যপ্রাচ্যে আটকে না থেকে ইউরোপজাপানে দক্ষ শ্রমিক পাঠানোয় জোর দেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন।

গত ২০ আগস্ট প্রবাসীকল্যাণ বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক . আসিফ নজরুল বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে আটকে না থেকে ইউরোপ, জাপান কোরিয়ায় দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দিকে জোর দেয়া হয়েছে।

আসিফ নজরুল আরও বলেছিলেন, শ্রমবাজার সম্প্রসারণের জন্য আমরা অনেকগুলো দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছি। অনেক বছর ধরে আমরা অদক্ষ শ্রমবাজারের ওপর নির্ভরশীল, মধ্যপ্রাচ্য হোক, মালয়েশিয়া হোক অদক্ষ শ্রমিকরা যাবে, অনেক টাকা বেতন পাবে, প্রতারিত হবে, কেউ কেউ দেশে ফেরত আসেবে। সেই জায়গা থেকে সরে এসে আমরা ইউরোপ, জাপান কোরিয়ায় দক্ষ শ্রমিক পাঠানোর দিকে জোর দিয়েছি। ইতোমধ্যে অনেকগুলো দেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তির বিষয়েও তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের ওমানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে; ইউরোপের সার্বিয়া, ইতালি, স্পেন, অস্ট্রিয়া মাল্টা। এছাড়া মরিশাস ইরাকে নতুন কর্মী পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর বাইরে সিজনাল কর্মী পাঠানোর জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রদেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে।

এর আগে গত ১৮ আগস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ ইনস্টিটিউটস ইন বাংলাদেশের (আজলিব) উদ্যোগে এক সেমিনারের জানানো হয়, দেশের জন্য জাপানের শ্রম মার্কেট š§ুক্ত হচ্ছে। বিদেশি শ্রমিকদের ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা ঋণ দেবে ব্যাংক। প্রতিবছর এক লাখ শ্রমিক জাপানে পাঠানোর উদ্যোগ প্রবাসী কল্যাণ বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের জাপান সেলের। তাছাড়া যেসব রিক্রুটিং এজেন্সি ছয় মাসে লোক পাঠাতে পারবে না, তাদের এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য মালয়েশিয়া এখনও বাংলাদেশের শ্রমবাজারের প্রধান গন্তব্য হলেও ইউরোপের ইতালি, গ্রিস, মাল্টা সাইপ্রাসে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। তবে এসব দেশে শ্রমিকদের যাত্রা প্রক্রিয়া এখনও ঝুঁকিপূর্ণ এবং বৈধ চ্যানেল সম্প্রসারণ না হলে তারা শোষণ মানবপাচারের ঝুঁকিতে পড়তে থাকবেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হলেও বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। তাদের মতে, নিরাপদ শ্রমবাজার বৈচিত্র্যময় গন্তব্যের সন্ধান না পেলে দেশের শ্রমশক্তি দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।