শ্রমিক সংগঠন বা সিবিএ থাকলেই শ্রম আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, কর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়—সে কথা আমাদের দেশের ক্ষেত্রে বোধ করি সর্বাংশে সত্য নয়। শ্রমিক নেতারা কাজই করেন না। বেশির ভাগই শ্রমিকদের ওপর ছড়ি ঘোরান, মালিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে নিজের স্বার্থ হাসিল করেন—এমনই ধারণা সাধারণ মানুষের। তবু সিবিএর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার জো নেই।
বর্তমানে শ্রম আইন সংশোধন করে কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন আরও সহজ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করতে ২০ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতি লাগে। সংশোধিত আইনে ‘শতাংশ’ আর থাকছে না। ন্যূনতম ২০ শ্রমিকের সায় থাকলেই ট্রেড ইউনিয়ন করা যাবে, এমন বিধান যুক্ত হচ্ছে। অর্থাৎ ১০০ শ্রমিক থাকলেই একটি কারখানায় সিবিএ থাকার সম্ভাবনা তৈরি হলো। মালিকপক্ষ অবশ্য এর বিরোধিতা করছে। শ্রমিকনেতাদের একটি অংশেরও দ্বিমত রয়েছে, যদিও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলছেন না।
ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের নতুন উদ্যোগটি যথাযথভাবে করা না গেলে শিল্পকারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন শ্রমিকনেতাদের একাংশ। তাদের যুক্তি, ২০ জনের সম্মতির সুযোগ নিয়ে মালিকপক্ষ, রাজনৈতিক দল কিংবা যেকোনো পক্ষ অসৎ উৎসাহে কারখানা পর্যায়ে ইউনিয়ন করে ফেলতে পারবে। এতে দর-কষাকষি করে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের জায়গাটি আরও দুর্বল হয়ে যাবে। মালিকপক্ষ প্রস্তাবিত বিধানটির বিরোধিতা করছেন। তাদের ধারণা, ২০ শ্রমিক নিয়ে গঠিত হলে তা ট্রেড ইউনিয়নকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে কারখানায় বিভাজন ও বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে, যা শেষ পর্যন্ত মালিক ও শ্রমিক উভয় পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর।
কিন্তু আমাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা গড়ে উঠেছে কি না, সেটিও বড় প্রশ্ন।
ট্রেড ইউনিয়ন গঠন সহজ করতে হলে শ্রম অধিদপ্তরের দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে আগে। সংগঠন করলে করলে শ্রমিকের চাকরি যাবে না, এটি নিশ্চিত করতে হবে। তবেই শ্রমিকদের দর-কষাকষির জায়গাটি শক্তিশালী হবে। বর্তমানে দেশে হাজার দশেক নিবন্ধিত ট্রেড ইউনিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ১ হাজার ৪০০। এসব ইউনিয়নের অধিকাংশই নিষ্ক্রিয়। আমাদের কমবেশি জানা আছে, পতিত সরকারের আমলের জনৈক শাজাহান খানের পকেটে ৫০টির অধিক শ্রমিক সংগঠন ছিল। তিনি লঞ্চ, বাস, ট্রাক, গার্মেন্ট, নিট প্রভৃতি অনেক প্রতিষ্ঠানই অঙ্গুলিহেলনে বন্ধ করে দিতে পারতেন। যেদিন তিনি চাইতেন সেদিন সব পরিবহন বন্ধ বা চালু থাকত। এমন অবস্থায় কে সুবিধা পেয়েছে, তা সবাই জানেন। শ্রমিক সংগঠন যেন কারও ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার না হয়, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। কোনোভাবেই স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না, অংশীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

Discussion about this post