সরকার গত সোমবার ‘শ্রম আইন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে। তৈরি পোশাক, ট্যানারি, ওষুধসহ বিভিন্ন খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরিকাঠামো এত দিন পাঁচ বছর পরপর নির্ধারণ হতো। এখন থেকে মজুরিকাঠামো তিন বছর অন্তর পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে তিন বছর পরপর বিভিন্ন শিল্প খাতের শ্রমিকের মজুরি বাড়বে। সংশোধিত শ্রম আইনে এমন বিধান রাখা হয়েছে।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী, জাতীয় ও খাতভিত্তিক ত্রিপক্ষীয় পরিষদ গঠন, জাতীয় সামাজিক সংলাপ ফোরাম ও বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। এ ছাড়া কোন কোন আচরণ যৌন হয়রানি হিসেবে গণ্য করা হবে, সেগুলোও আইনে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। শ্রমিকের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, ধর্ম, রাজনৈতিক মতামত, জাতীয়তা, সামাজিক অবস্থান, বংশ বা প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো ব্যক্তিকে আলাদা করা, বাদ দেয়া বা কম গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি যুক্ত রয়েছে আইনে।
সংশোধিত শ্রম আইন নিয়ে শ্রমিকনেতারা সন্তোষ প্রকাশ করলেও শিল্পমালিকেরা কয়েকটি বিধান নিয়ে ক্ষুব্ধ। তাদের দাবি, শ্রমিকের সংজ্ঞায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে আসায় বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য একটি শ্রমিক সংগঠনের এক নেতা বলেছেন, আইনটি শ্রমিকবান্ধব হলেও মালিকপক্ষের শঙ্কার কোনো কারণ নেই। এটি বাস্তবায়নে সরকার, মালিক ও শ্রমিকপক্ষকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশের শ্রমিকশ্রেণির জীবনমান, অধিকার ও কর্মপরিবেশ এখনো প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। অর্থনীতিতে বৃহৎ অবদান রাখা সত্ত্বেও শ্রমিকেরা চূড়ান্ত পর্যায়ের অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত, যেখানে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে এখান থেকে। কিন্তু এ খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশই পান না যথোপযুক্ত মজুরি। নিরাপদ কর্মপরিবেশের অভাবে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে, যেমন রানা প্লাজা-স্পেকট্রাম গার্মেন্ট ধস কিংবা তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন।
অধিকার নিয়ে শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুই ধরনের চিত্র লক্ষণীয়। কেউ আদতেই আন্তরিক ও ত্যাগী; অন্যদিকে কেউ নেতা কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানমালিকের স্বার্থ, রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি করেন। ফলে শ্রমিকদের প্রকৃত স্বার্থ উপেক্ষিত থেকে যায়। রাষ্ট্রও শ্রমিকদের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারে না। এবারও শ্রম আইন নিয়ে মালিকরা দ্বিমত পোষণ করেছেন। শ্রমিকের সংজ্ঞায় কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে আসায় তাদের আপত্তি! কর্মকর্তারা প্রায়ই মলিকের প্রতিভূ হিসেবে অবস্থান নেন। সম্ভবত নতুন আইনে অস্বস্তিতে পড়বেন তারা। কারণ এদের সঙ্গে শ্রমিকদের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। শ্রমিকরা ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি নিয়ে কথা বললেও শ্রমিকদের নিবৃত্ত করতে তাদের ছাঁটাই করা হয়, ভয়ভীতি দেখানো হয়; এমনকি হয়রানি, হামলা বা মামলা দেয়া হয়। এখন হয়তো সে ধরনের চর্চা বন্ধ হবে। আমরা বিশ্বাস করি, শ্রম যথারীতি বাস্তবায়ন করা গেলে শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের কল্যাণ শুধু নৈতিক দায়িত্ব নয়, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার পূর্বশর্তও বটে। কর্মিবান্ধব পরিবেশ কর্মক্ষমতা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, যার সুফল মালিকরাও পান।
