Print Date & Time : 21 September 2025 Sunday 3:43 am

সংকটেও সার কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় পেট্রোবাংলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : বর্তমানে দেশে কৃষি উৎপাদনের এক গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম চললেও সার সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সার উৎপাদনকারী কারখানায় গ্যাসের দাম বাড়াতে চায় বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। বিষয়টি নিয়ে আগামী ৬ অক্টোবর একটি গণশুনানির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে এ শুনানিতে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), যা পুরো প্রক্রিয়াকে ঘিরে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছে।
কৃষকরা জানান, আমন মৌসুমে সারের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কৃষক ফুলজার হোসেন বলেন, ‘এক একর ৩৫ শতক জমিতে আমন ধান রোপণ করেছি। এখন সারের খুব দরকার। কিন্তু ডিলারদের কাছে সার নেই, বাধ্য হয়ে খোলাবাজারে ১ হাজার ৪৪৫ টাকা দরে দুই বস্তা সার কিনেছি।’
একই অভিযোগ করেন ভূরুঙ্গামারীর কৃষক আজহার আলীও। তিনি বলেন, ‘ডিলাররা কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করতে চান না। খোলাবাজারে গেলে বেশি দামে কিনতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে আমরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছি।’ ‘রাষ্ট্র সংস্কার কৃষক আন্দোলন’ নামক একটি সংগঠন সার সংকটের প্রতিবাদে কুড়িগ্রামে বিক্ষোভও করেছে।
এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে পেট্রোবাংলা সার কারখানায় ব্যবহƒত গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে, যা নতুন করে কৃষকদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। যদিও এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিইআরসি গণশুনানির আয়োজন করেছে, সেখানে অংশ না নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্যাব। সংগঠনটির দাবি, বিইআরসি স্বচ্ছতা ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছে না।
ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, ‘আইন অনুযায়ী জ্বালানির দাম নির্ধারণে উš§ুক্ত শুনানির মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারদের মতো নেয়ার কথা থাকলেও বিইআরসি তা মানছে না। বর্তমানে নির্বাহী আদেশেই সব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কমিশন। শুনানি করলেও দাম বাড়বে, না করলেও বাড়বেÑবিইআরসি ১২-১৪ বছর ধরে এমনই করছে। এই অবৈধ প্রক্রিয়ায় ক্যাব অংশগ্রহণ করতে পারে না।’
অন্যদিকে জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান ক্যাবকে শুনানিতে অংশ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বিইআরসি হয়তো দাম বাড়াবে না, কিন্তু আলোচনা হওয়া উচিত। তাছাড়া গ্যাসের দাম বাড়লেই যে সারের দাম বাড়বে, তা ঠিক নয়।’
বিইআরসি সূত্রে জানা গেছে, পেট্রোবাংলার দাখিল করা প্রস্তাবে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করার আবেদন করা হয়েছে। আর তিতাস দাম বৃদ্ধিতে একই প্রস্তাব দিয়েছে।
বিইআরসি ১১ সেপ্টেম্বর গণশুনানির বিজ্ঞপ্তি জারি করে এবং অংশগ্রহণের জন্য আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। যদিও ক্যাব শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়াকে ‘লোক দেখানো’ বলে অভিযোগ করে আসছে এবং বিইআরসি চেয়ারম্যান ও সদস্যদের অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠিও দিয়েছে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, ‘সারে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি-সংক্রান্ত পেট্রোবাংলার প্রস্তাবটি পেয়েছি। আজ (গতকাল) তিতাসের প্রস্তাবও পেয়েছি। সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করা বাকি কোম্পানিগুলো এখনও প্রস্তাব দেয়নি। প্রস্তাবগুলো পেলে নিয়ম অনুযায়ী যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে, সেগুলো আমরা শুরু করব।’
পেট্রোবাংলা বলছে, আবেদনের বিপরীতে বিইআরসি গ্যাসের দাম বাড়ালে সারে গ্যাস সরবরাহ বাড়িয়ে দেবে পেট্রোবাংলা। দীর্ঘদিন ধরে সার কারখানাগুলোয় গ্যাসের সংকট রয়েছে। চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাসের সরববরাহ বাড়াতে হলে অর্থের প্রয়োজন। তাতে বাড়তি এলএনজি আনা গেলে সার কারখানাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস বৃদ্ধি করতে পারবে পেট্রোবাংলা। গ্যাসের দাম নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় ও বিসিআইসির মধ্যে দীর্ঘদিন এক ধরনের বিরোধ চলছিল বলে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, দাম বাড়ানো হলে অক্টোবর-মার্চ (ছয় মাস) পর্যন্ত চাহিদার ২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের পুরোটাই সরবরাহ করা হবে। অবশিষ্ট ছয় মাসের মধ্যে এপ্রিল-মে মাসে ১৬৫ মিলিয়ন, জুনে ১৭৫ মিলিয়ন এবং জুলাই-সেপ্টেম্বরে ১৩০ মিলিয়ন ঘনফুট হারে গ্যাস সরবরাহ দেবে। বর্তমানে সার উৎপাদনে দৈনিক ৬৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়া হচ্ছে।
তিতাসের প্রস্তাবে গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ১৬ টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাব অনুযায়ী বিইআরসি দাম বাড়ালে সারে সরবরাহ বাড়াতে পারবে তিতাস।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শাহনেওয়াজ পারভেজ বলেন, ‘আমরা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব বিইআরসিতে পাঠিয়েছি। দাম বাড়ানো হলে আশা করি গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে। তাতে সার কারখানাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যাবে।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরে দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদা প্রায় ৭০ লাখ টন। মোট চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। দেশে উৎপাদিত সার মূলত ইউরিয়া, যা সরকারি কারখানাগুলোতে উৎপাদিত হয়। ফলে উৎপাদন ব্যয় বাড়লে সেটি কৃষকদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সিস্টেম লস কমাতে কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে বারবার গ্রাহকদের ওপর দাম বৃদ্ধির চাপ দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে কৃষক এবং সাধারণ জনগণকেই ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।