Print Date & Time : 21 September 2025 Sunday 4:11 am

সংকটে কাঁচা পাট রপ্তানি অনিশ্চতায় ভবিষ্যৎ

অশোক দত্ত : সোনালি আঁশখ্যাত পাট দেশের অন্যতম বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস। কিন্তু শ্রমিক অসন্তোষ, চুক্তি মোতাবেক মানসম্মত পণ্য সরবরাহ না করা, সরকারি সিদ্ধান্তে শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানি এবং প্রতিবেশী দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে ধাপে ধাপে প্রায় অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কাঁচা পাট রপ্তানি। এতে করে বিপাকে পড়েছেন পাট ব্যবসায়ী ও রপ্তানিকারকরা। দফায় দফায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রেতারা। এতে বছর বছর হাতছাড়া হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজার এবং কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার আয়।
গত ২৫ আগস্ট বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টার কাছে কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের আবেদন করে। তাদের এ আবেদনের ভিত্তিতেই ৮ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হঠাৎ শর্ত ছাড়া কাঁচা পাট রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগেও ২০০৯-১০ সালের পর তিন চার দফায় রপ্তানি বন্ধ করা হয়েছিল। সম্প্রতি সময়ে সরকারের হঠাৎ করা প্রজ্ঞাপন এবং ভারতের আকস্মিক নিষেধাজ্ঞা মিলিয়ে কাঁচা পাট রপ্তানি কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
এ প্রসঙ্গে বস্ত্র ও পাট সচিব মো. আব্দুর রউফ শেয়ার বিজকে বলেন, কাঁচা পাট রপ্তানি করে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তার থেকে অধিক পরিমাণ আয় হয় পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে। বর্তমান বিশ্ববাজারে আমাদের পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েছে এবং দেশের ভেতরেও পাটপণ্যের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে তাই পাটজাত পণ্য উৎপাদনে কাঁচা পাটের চাহিদাও দ্বিগুণ বড়েছে। এর সঙ্গে বিভিন্নভাবে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান জড়িত। সবকিছু বিবেচনা করে দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৮ সেপ্টেম্বর এক পরিপত্রে জানায়, শর্ত ছাড়া আর কাঁচা পাট রপ্তানি করা যাবে না। এ সিদ্ধান্তের ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বন্দরে থাকা পূর্ব অনুমোদিত চালানগুলোও আটকে দেয়। এতে প্রায় ৫০ হাজার টনের বেশি চালান বন্দরে আটকে যায়, যা নিয়ে রপ্তানিকারকরা ভোগান্তিতে পড়ে। অথচ রপ্তানির প্রায় সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর এ ধরনের সিদ্ধান্তে ব্যবসায়ীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এর তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিবেচনায় নেয়া হয়নি। এতে শুধু পণ্য আটকে নয়, বাড়তি ট্রাক ভাড়া ও বন্দরের জরিমানা দিতে হয়েছে রপ্তানিকারকদের।
প্রায় ১০ দিন ধরে এ ভোগান্তি চলার পর অবশেষে ১৮ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করে জানায়, ৮ সেপ্টেম্বরের আগে যেসব চালানের শিপিং বিল জমা পড়েছিল, সেগুলো আর আটকে থাকবে না।
এ প্রসঙ্গে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান তাসফিয়া জুট ট্রেডিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খন্দকার আলমগীর হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, না জানিয়ে হঠাৎ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে আমদানি এবং রপ্তানিকারক উভয়ের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। এতে অর্ডার বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আর তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ব্যবসায়ীসহ হাজার হাজার শ্রমিক।
তিনি বলেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত ধাপে ধাপে নিলে ভালো হয়, তাহলে হঠাৎ করে রপ্তানি আটকে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হয় না।
বাংলাদেশের কাঁচাপাট রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার হলো ভারত। অথচ গত ২৭ জুন ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তর আকস্মিক এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট ও পাটজাত নয়টি পণ্যের আমদানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর আওতায় কাঁচা পাট, জুট রোল, সুতা, বোনা কাপড়সহ নানা ধরনের পাটপণ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে চলতি অর্থবছরে যে ১২টি দেশে কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে, তার মধ্যে ভারতের অবস্থান শীর্ষে। শুধু ভারত থেকেই এসেছে ৯ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। ফলে ভারতের এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকলে কৃষক, রপ্তানিকারক, এমনকি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান ফরহাদ আহমেদ (পম্পি) শেয়ার বিজকে বলেন, বিশ্বের মানসম্পন্ন কাঁচা পাট উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে আমাদের দেশের বিকল্প নেই। তবুও দফায় দফায় সরকারের নীতি পরিবর্তন, রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এবং বৈদেশিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ক্রমেই আন্তর্জাতিক বাজার হারাচ্ছে আর এই বাজার হারানোর ফলে শুধু রপ্তানিকারকরাই লোকসানে পড়ছে না, তাদের মাথায় চাপছে বিশাল অঙ্কের ব্যাংক ঋণের বোঝা। ফলে ব্যাংকেও বাড়ছে ঋণখেলাপির সংখ্যা।
তিনি বলেন, বারবার রপ্তানি ব্যাহত হওয়ায় হুমকিতে পড়ছে অভ্যন্তরীণ দামের বাজারে এতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে তাদের আগ্রহ কমছে পাট উৎপাদনে। জুলাই থেকে মৌসুম শুরু হলেও ব্যাংকগুলো নতুন করে রপ্তানিকারকদের ঋণ দিতে দেখাচ্ছে অনীহা। ফলে খুলনার দৌলতপুর ও নারায়ণগঞ্জের মতো ঐতিহ্যবাহী পাট মোকামে বিরাজ করছে মন্দাভাব।
একসময় ২৯টি দেশে পাট রপ্তানি হতো, বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১২টিতে।
যেসব দেশ থেকে বাংলাদেশ বাজার হারিয়েছে তার মধ্যে রয়েছেÑবেলজিয়াম, কিউবা, মিসর, জার্মানি, ইতালি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, রোমানিয়া ও ফিলিপাইনসহ মোট ১৭টি দেশ। এখন রপ্তানি হচ্ছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ব্রাজিল, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, তিউনিসিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) মহাসচিব বারিক খান শেয়ার বিজকে বলেন, বছরে দেশে উৎপাদিত ৭৫ থেকে ৮০ লাখ বেল পাটের মধ্যে প্রায় ৬০ লাখ বেল দেশের অভ্যন্তরীণ পাটপণ্য উৎপাদনেই লাগে। ফলে কাঁচা পাট রপ্তানি অব্যাহত থাকলে স্থানীয় শিল্প কাঁচামালের সংকটে পড়বে।
পাট অধিদপ্তরের সূত্র মতে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার ৯৩৫ বেল এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৮৩ লাখ ১৫ হাজার ৫৬০ বেল; যা গত বছরের তুলনায় ৮ লাখ ১৬ হাজার ৬২৫ বেল বেশি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, উৎপাদন বেশি হচ্ছে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে যদি স্টক পর্যাপ্ত থাকে তাহলে কাঁচা পাট রপ্তানি করলে কোনো ক্ষতি হবে না।
পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীনসহ ১৩টি দেশে প্রায় ১৩ লাখ ৪৪ হাজার ৮৩৫ বেল কাঁচা পাট রপ্তানি হয়েছে। এর বাজারমূল্য ছিল ১ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা ১৬ কোটি মার্কিন ডলারের সমান। এর মধ্যে ভারতের অবদানই ছিল অর্ধেকের বেশি।
এ অবস্থায় ভারতের নিষেধাজ্ঞা ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি পরিবর্তন মিলিয়ে পাট রপ্তানি খাত ভবিষ্যতে আরও বড় সংকটে পড়বে বলে আশঙ্কা করছে কাঁচা পাট রপ্তানিকারকরা। এ খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যদি দ্রুত কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ভারতের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া যায় না এবং অভ্যন্তরীণ নীতি স্পষ্ট করা না হয়, তাহলে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ আরও বড় বাজার হারাবে।