Print Date & Time : 16 November 2025 Sunday 2:26 am

সততা ও প্রজ্ঞার রাজনীতি হোক পুনর্জাগরণের অঙ্গীকার

সুলতান মাহমুদ সরকার : বাংলাদেশ একটি নাম, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে সংগ্রাম, ত্যাগ, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দীপ্ত ইতিহাস। নদীমাতৃক এই দেশটি শুধু ভৌগোলিক সৌন্দর্যে নয়, বরং মানবিক মমতা, সামাজিক বন্ধন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে অনন্য। দক্ষিণ এশিয়ার হƒদয়ে অবস্থান এই রাষ্ট্রের, যার সীমান্ত স্পর্শ করেছে ভারত ও মিয়ানমারের মতো বৃহৎ দেশকে, আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের নীল জলরাশি যেন আহ্বান জানায় বিশ্ব অর্থনীতির নতুন দিগন্তে। বাংলাদেশের ইতিহাস বললে উঠে আসে এক যুদ্ধজয়ের কাব্য, এক জাতির আত্মনির্ধারণের ঘোষণাপত্র। এই দেশ একসময় পরাধীনতার অন্ধকার ভেঙে সূর্যের মতো উঠেছিল স্বাধীনতার ভোরে। সেই আত্মত্যাগের ইতিহাসই আজও জাতির চলার প্রেরণা। কিন্তু স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে এসেও এই ভূখণ্ডে এখনও এক প্রশ্ন জাগে-আমাদের রাজনীতি কি সত্যিই জনগণের জন্য, নাকি কেবল ক্ষমতার জন্য?

বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ। এখানকার মানুষ পরিশ্রমী, সহনশীল ও সহমর্মী। গ্রামের মেঠোপথ থেকে শহরের কোলাহলে মানুষের মনের গভীরে এখনও লুকিয়ে আছে শান্তির আকাক্সক্ষা। ইতিহাস সাক্ষী, এই দেশ কখনও অন্যের ক্ষতি চায়নি; বরং মানবতার কল্যাণে আত্মনিবেদিত থেকেছে। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রায়ই সেই শান্ত চিত্রকে ধূসর করে দেয়। একসময় যে রাজনীতি ছিল মানুষের মুক্তির হাতিয়ার, তা এখন অনেক ক্ষেত্রেই পরিণত হয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রতিযোগিতার ময়দানে। দলগুলো নিজেদের মতাদর্শের ঊর্ধ্বে গিয়ে স্বার্থরক্ষার দুর্গ বানিয়েছে ক্ষমতার প্রাসাদ। ফলস্বরূপ জনগণ আজ অনেক সময়ই বঞ্চিত হয়েছে তাদের মৌলিক অধিকার থেকে। তবুও এই দেশের মানুষ আশাবাদী। তারা বিশ্বাস করে, যদি রাজনীতির হাল ধরেন মেধাবী, সৎ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, তবেই বাংলাদেশ বদলে যেতে পারে।

রাজনীতির ইতিহাসে বাংলাদেশের পথচলা অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার পর প্রথম কয়েক বছর ছিল আদর্শিক উত্তেজনা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের টানাপোড়েন, সামরিক হস্তক্ষেপ ও দলীয় বিভাজন। সময়ের পরিক্রমায় একাধিক সরকার এসেছে, গিয়েছে; কিন্তু গণতন্ত্রের ভিত কখনোই পুরোপুরি দৃঢ় হয়নি। বরং একসময় রাজনীতি হয়ে উঠেছে ক্ষমতার লড়াইয়ের প্রতীক, যেখানে দলীয় আনুগত্যই হয়ে দাঁড়ায় যোগ্যতার মাপকাঠি। অথচ রাজনীতি তো হওয়া উচিত জনগণের কল্যাণের বিজ্ঞান, যেখানে নেতৃত্ব গড়ে উঠবে মেধা, সততা ও নৈতিকতার ভিত্তিতে। এদেশে সেই নেতৃত্বের অভাবই বারবার জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছে হতাশার গহ্বরে। কিন্তু আজ সময় বদলাচ্ছে। একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতি আর কেবল সেøাগান বা পোস্টারনির্ভর নয়, বরং এখন রাজনীতি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তি, নীতি ও বিশ্বসংযোগের সমন্বয়।

যুবসমাজ এখন রাজনীতিকে নতুন চোখে দেখছে। তারা চায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও বাস্তব পরিবর্তন। তারা আর কেবল দলীয় ভাষণ শুনে তুষ্ট নয়; তারা চায় তথ্যনির্ভর নেতৃত্ব, সিদ্ধান্তে যুক্তি ও পরিকল্পনায় পেশাদারত্ব। এই তরুণ প্রজš§ই বাংলাদেশের আসল শক্তি। তাদের হাতেই ভবিষ্যতের রাজনীতি গড়ে উঠবে। আজকের ডিজিটাল যুগে তারা বিশ্বমানের শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সঙ্গে সংযুক্ত। তারা বুঝতে শিখেছে বিশ্ব রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে নেতৃত্বকে হতে হবে জ্ঞাননির্ভর, কূটনীতিতে দৃঢ় ও অর্থনীতিতে আত্মনির্ভর। তাই রাজনীতির নতুন সুবাতাস আসবেই, যদি তরুণরা মেধা ও সততার সঙ্গে নেতৃত্বে যুক্ত হয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহাবস্থানের ঐতিহ্য ছিল একসময় অনন্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতাদর্শ ভিন্ন হলেও সবাই এক লক্ষ্যেই ঐক্যবদ্ধ ছিল ‘স্বাধীনতা’। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেই সহাবস্থান অনেকটা হারিয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিরোধ এখন অনেক সময় হয়ে দাঁড়ায় শত্রুতা, আর মতের ভিন্নতা পরিণত হয় ঘৃণায়। অথচ সভ্য সমাজে রাজনীতির মূল শক্তি হওয়া উচিত সংলাপ, সংঘাত নয়। রাজনৈতিক পরিসরে সহমর্মিতা ও সহনশীলতার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব যখন সহাবস্থানের মডেল হিসেবে ‘সমঝোতা রাজনীতি’র চর্চা করছে, বাংলাদেশ তখনও যেন বন্দি ক্ষমতার দ্বন্দ্বে। তবুও আশার আলো আছে, কারণ নতুন প্রজšে§র চিন্তায় এখন উঠছে পরিবর্তনের সুর, গুনগুন করছে নতুন আদর্শের সংগীত।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। জনগণ তখন বুঝে ফেলেছিল, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। রাজনীতিতে পুরোনো রীতিনীতির দিন শেষ। মানুষ চায় নেতৃত্বে যোগ্যতা, চায় সিদ্ধান্তে মানবিকতা। সেই সময়ের আন্দোলন শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের নয়, এটি ছিল মানসিক বিপ্লব ও চিন্তাধারার পরিবর্তন। যারা বছরের পর বছর রাজনীতিকে একচেটিয়া দখলে রেখেছিল, তারা তখন টের পায় মানুষের ভেতরে জš§ নিয়েছে নতুন প্রত্যাশা। জনগণ চায় এমন এক রাজনীতি, যেখানে নেতা জনগণের সেবক, প্রভু নয়। চায় এমন সরকার, যেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দেশের কল্যাণে, দলের স্বার্থে নয়। জুলাইয়ের সেই বিপ্লব তাই শুধু রাজনৈতিক পালাবদল নয়, ছিল সামাজিক জাগরণের সূচনা। এর পরের দিনগুলোয় মানুষ প্রত্যাশা করেছিল, এবার হয়তো রাজনীতিতে সত্যিই আসবে সুবাতাস।

আজ যখন আমরা সেই সময় পেরিয়ে নতুন দিনে পা রাখছি, তখনও অনেক কিছু বাকি। কিন্তু যে চিন্তায় পরিবর্তনের ঢেউ উঠেছে, তা এখন আর থামার নয়। মানুষের মনে যে প্রত্যাশা জেগেছে, তা এখন নেতৃত্বকে বদলাতে বাধ্য করছে। কারণ জনগণ এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কখনই টেকসই হবে না, যদি আইনের শাসন না থাকে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন অর্থহীন হয়, যদি স্বচ্ছতা না থাকে। এমনকি কূটনীতি দুর্বল হবে, যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে নৈতিকতা না থাকে। আজ মানুষ চায় রাজনীতিতে জবাবদিহিতা। তারা চায়, সরকারি দপ্তরে দুর্নীতির জায়গায় আসুক দক্ষতা, প্রশাসনে প্রভাবশালী নয়, বরং সৎ কর্মকর্তার প্রাধান্য পাক; চায় শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনীতি নয়, জ্ঞানের চর্চা হোক মুখ্য।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাংলাদেশের বড় অর্জন। কিন্তু এই উন্নয়নকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে রাজনীতিকে হতে হবে প্রজ্ঞাপূর্ণ। শিল্প, বাণিজ্য, কৃষি, প্রযুক্তিÑসব ক্ষেত্রে সঠিক দিকনির্দেশনা ছাড়া উন্নয়ন টেকসই হয় না। এজন্য দরকার দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব, যে নেতৃত্ব জানবে কূটনীতির ভাষা, বুঝবে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবণতা এবং একইসঙ্গে নিজের জনগণের চাহিদাও। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে এই দেশ এক সম্ভাবনার কেন্দ্র। তাই নেতৃত্বকে হতে হবে এমন, যে নেতৃত্ব শুধু অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নয়, আঞ্চলিক কূটনীতিতেও দক্ষ। ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ হতে পারে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক শক্তি।

এ লক্ষ্য অর্জনে দরকার আইন ও শৃঙ্খলার দৃঢ়তা। জনগণের আস্থা তখনই ফিরে আসবে, যখন আইনের প্রয়োগ হবে নিরপেক্ষভাবে। অপরাধী যে-ই হোক, বিচার হতে হবে স্বচ্ছ ও দ্রুত। রাজনৈতিক প্রভাবের ছায়া থেকে মুক্ত করতে হবে বিচারব্যবস্থা। কেননা ন্যায়বিচারই গণতন্ত্রের প্রাণ। গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড যখন শক্ত হবে, তখনই রাজনীতিতে জš§ নেবে সত্যিকার সুবাতাস।

একইসঙ্গে দরকার মানসিক বিপ্লব। রাজনীতিকে কেবল দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বের করে আনতে হবে জাতীয় উন্নয়নের মঞ্চে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, নারী উন্নয়ন, প্রযুক্তি ও গবেষণার মতো খাতে সমন্বিত চিন্তা দরকার। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি আন্তরিকভাবে এগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, হবে এক পরিপূর্ণ কল্যাণরাষ্ট্র। আর এজন্য দরকার রাজনীতিতে বিশুদ্ধ চিন্তাধারার মানুষ, যারা মেধাবী, সৎ, দূরদর্শী ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে প্রস্তুত। সুতরাং আজকের সেই তরুণ প্রজš§ই জাতিকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। তাদের মধ্যে আছে অদম্য সাহস, উদ্ভাবনী চিন্তা ও দায়িত্ববোধ। তারা বুঝতে পারে যে পরিবর্তন শুধু সেøাগানে নয়, কাজের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। আজ সময় এসেছে প্রজš§ান্তরের সেতুবন্ধ গড়ার, যেখানে অভিজ্ঞতা ও মেধা মিলেমিশে তৈরি করবে নতুন বাংলাদেশ।

রাজনীতিতে সুবাতাস মানে শুধু ক্ষমতার পরিবর্তন নয়, এটি নৈতিকতার পুনর্জাগরণ। এর মানে হলো সততার রাজনীতি, জবাবদিহিতার সরকার এবং সেবাধর্মী নেতৃত্ব। এটি এমন এক সময়ের আহ্বান, যখন নেতা ও জনগণের মধ্যে ভরসার সম্পর্ক পুনর্গঠিত হতে হবে। গণতন্ত্রের সৌন্দর্য তখনই উজ্জ্বল হবে, যখন প্রতিটি নাগরিক মনে করবে রাষ্ট্র তার, সরকার তার, আর রাজনীতি তার জীবনের অংশ।

বাংলাদেশ এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের দোরগোড়ায়। এই দেশ যে জাতির রক্তে তৈরি, তারা জানে কীভাবে অসম্ভবকে সম্ভব করতে হয়। সেই জাতি আজ আবারও প্রস্তুত নতুন অভিযাত্রায়, যেখানে রাজনীতির লক্ষ্য হবে মানুষ, উন্নয়নের মাপকাঠি হবে মানবিকতা, আর নেতৃত্বের আসনে বসবে যোগ্য, সৎ ও প্রজ্ঞাবান মানুষ। সুবাতাস বইবেই, যদি আমরা সবাই মিলে রাজনীতিকে গড়ে তুলি নৈতিকতার শিল্প, সহমর্মিতার দর্শন এবং উন্নয়নের অঙ্গীকার হিসেবে। সময় এসেছে রাজনীতিকে পেশাদারত্বে, শিক্ষায় এবং নৈতিকতায় সমৃদ্ধ করার। সময় এসেছে পুরোনো সংস্কার ভেঙে নতুন সূর্যের দিকে তাকানোর।

এই দেশ নদীর মতোই প্রবহমান-কখনও থামে না, শুধু দিক পরিবর্তন করে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশও তেমনি চলবে, যদি রাজনীতিতে আসে সেই সুবাতাস, যেখানে মেধা, সততা ও যোগ্যতার সমন্বয়ে গড়ে উঠবে এক নতুন স্বপ্নের রাষ্ট্র। আর সেই দিনই প্রত্যাশিত, যখন দেশবাসী গর্ব করে বলতে পারব, ‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ বদলে গেছে।’

শিক্ষক

গাজীপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ

sultanmh17@gmail.com