শেখ শাফায়াত হোসেন : দুই মাস আগে সংঘটিত এক হ্যাকিংয়ের পর এখনও সেবা-সংক্রান্ত সার্ভার সচল করতে পারেনি রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এতে ভবনের নকশা অনুমোদন, সংশোধনীর আবেদনসহ অনেক ধরনের অনলাইন সেবা পেতে ভোগান্তিতে পড়ছেন গ্রাহকরা।
এদিকে দীর্ঘ দুই মাস ধরে সার্ভার চালু না থাকায় জরুরি সেবাগুলো অফলাইনে র্আৎ রাজউক ভবনে গিয়ে কর্মকর্তাদের টেবিলে বসে সম্পাদন করতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এর ফলে আবারও সেই ঘ–ষ ও তদবিরের ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন তারা।
গতকাল সোমবার রাজউক ভবনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে অধিকাংশ দপ্তরে সেবাগ্রহীতাদের ভিড়। এমনকি চেয়ারম্যানের দপ্তরের সামনেও ভিড় লেগে রয়েছে।
সেখানে ভবনের নকশা অনুমোদনের আবেদন সংশোধনীর জন্য বর্ধিত সময়ের আবেদন করতে মাকে নিয়ে আসেন এক নারী গ্রাহক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই সেবাগ্রহীতা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা বাড়ি নির্মাণের নকশা অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিলাম। তবে ওই আবেদনে কিছু ভুল ছিল। এই ভুল অনলাইনেই সংশোধনও করা যায়। তবে তার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় থাকে। সেই সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা আইডি-পাসওয়ার্ড দিয়ে সার্ভারে আগে যেমন ঢুকতাম, সেভাবে আর ঢুকতে পারছি না। একারণে সশরীরে রাজউক অফিসে এলাম।’
ওই গ্রাহক আরও বলেন, ‘আমরা জানতামও না যে এখানে সনাতন পদ্ধতিতে আবেদন জমা নিচ্ছে। কর্মকর্তারা জানালেন, সার্ভার বন্ধ থাকায় ভূরি ভূরি আবেদনপত্র হাতে হাতে জমা দিয়ে যাচ্ছেন গ্রাহকরা। আমাদের একটি আবেদন দেখিয়ে বললেন, আমরা যেন ওই একইভাবে আবেদন দিয়ে যাই। এ কারণে বসে বসে আবেদন লিখছি।’
ওই দিন আরও বেশ কয়েকজন গ্রাহকের রাজউকের চেয়ারম্যানের দপ্তরের সামনে বসে থাকতে দেখা যায়। তারা বলেন, অনেক দিন হলো সার্ভার অচল। এটা কেন দ্রুত সময়ের মধ্যে সচল করছে না, তা বুঝতে পারছি না। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে একটা সার্ভার ঠিক করতে দুই মাস সময় লাগার কথা নয়।
এ সময় বদিউল আলম নামের এক সেবাগ্রহীতা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘এভাবে রাজউকের দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে থাকলে আবার সেই ঘুষের সুযোগ পাবে কর্মকর্তারা। তদবির তো ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। অনেককেই দেখছি বড়কর্তাদের রুমে বসে এসব নিয়ে আলোচনা করছেন, চা খাচ্ছেন।’
যদিও দ্রুত সার্ভারের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন রাজউক চেয়ারম্যান। গতকাল সোমবার রাজউক চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার মো. রিয়াজুল ইসলাম শেয়ার বিজকে বলেন, আমরা কাজ করছি। এক সপ্তাহের মধ্যে সার্ভার সচল হবে আশা করি। জনবল সংকটে কাজটি শেষ করতে দেরি হচ্ছে। সার্ভার সচল হতে দেরি হওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে আগের মতো কাগজে লেখা আবেদন জমা নেয়া হচ্ছে। বর্তমানে আমরা আগের জমা পড়া আবেদনের সংশোধনীর আবেদন সশরীরে নিচ্ছি।’
জানা গেছে, গত ১৯ মে রাজউকের ইলেকট্রনিক কনস্ট্রাকশন পারমিটিং সিস্টেম (ইসিপিএস) সার্ভার হ্যাক হয়। এর পর থেকেই বন্ধ আছে জমির ছাড়পত্র সনদ দেয়ার অনলাইন সেবা। দেয়া হচ্ছে না ভবন তৈরির নকশার অনুমোদন। ফলে অনেকের প্রস্তুতি থাকলেও সময়মতো বাড়ি নির্মাণের কাজ শুরু করতে পারছে না।
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এক জমির মালিক সেখানে একটি বাড়ি নির্মাণের জন্য ব্যাংকঋণের আবেদন করবেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু সময়মতো নকশার অনুমোদন না পাওয়ায় ঋণও পাচ্ছেন না, বাড়ি নির্মাণের কাজও শুরু করতে পারছেন না। এদিকে জমানো টাকা একটু একটু করে খরচ হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন।
গতকাল রাজউক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ওই জমির মালিক বলেন, ‘সবকিছু অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। কবে অনুমোদন মিলবে, তার কোনো সঠিক সময় জানতে পারছি না। এভাবে চললে পরিকল্পনা অনুযায়ী বাড়ি নির্মাণ করা কঠিন হবে। জমানো টাকাও নানা কাজে ব্যয় হয়ে যাবে।’
আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভুঁইয়া শেয়ার বিজকে বলেন, ‘এই সমস্যার ফলে শুধু যে ভবনের নকশা অনুমোদন হচ্ছে না তা নয়, দৈনন্দিন অনেক কাজই এই সার্ভারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। সার্ভার বন্ধ থাকায় সেই সেবাগুলো পাওয়া যাচ্ছে না। আমরা বারবার রাজউককে এর দ্রুত সমাধানের তাগাদা দিচ্ছি।’
জানা গেছে, গত ১৯ মে ইসিপিএস সার্ভারে অনুপ্রবেশ করে মাত্র ১৭ মিনিটে একটি ভবনের অনুমোদন পাশের ঘটনা নজরে আসে রাজউক কর্তৃপক্ষের। জলাভূমি ও হাইট রেস্ট্রিকশন থাকা ভূমিতে ১৫ তলাবিশিষ্ট ১৮৫ ইউনিটের ভবনের নকশা সব বিধিকে পাশ কাটিয়ে পাস করিয়ে নেয় হ্যাকাররা। রাজউক কর্তৃপক্ষ ঘটনাটি জানতে পেরে প্রাথমিক তদন্তে একই উপায়ে আরও তিনটি ভবনের নকশা অনুমোদনের প্রক্রিয়াধীন অবস্থায় পায়। তৎক্ষণাৎ সার্ভারটি বন্ধ করে দেয় রাজউক কর্তৃপক্ষ। রাজউকের পক্ষ থেকে এবং মতিঝিল থানায় সেদিনই একটি সাধারণ ডায়রি (জিডি) করা হয়।
পাস করা নকশার সূত্র ধরে রাবেয়া বারী নামক এক প্রকৌশলীর সন্ধান পায় রাজউক, যার স্বাক্ষর নকশাগুলোতে পাওয়া যায়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে মতিঝিলের একটি কম্পিউটারের দোকান ও সেখানকার এক কর্মচারীর নাম।
রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনির হোসেন হাওলাদারের নেতৃত্বে গত ২২ মে একটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয় মতিঝিলের ওই দোকানটিতে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে দোকানটির সঙ্গে অননুমোদিত নকশার সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়। একইসঙ্গে দোকানটির মালিকের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে রাজউকের নির্ধারিত ফি পরিশোধের প্রমাণ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া দোকানের কয়েকটি কম্পিউটারে ওই অবৈধ ভবনগুলোর নকশা পাওয়া যায়, যা থেকে দোকানের মালিক এনামুল ও কর্মচারী স্বপনের সম্পৃক্ততা প্রতীয়মান হয়। মোবাইল কোর্ট চলাকালে তাদের কাউকেই না পাওয়ায় সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মচারীদের পুলিশের আওতায় আনা হয়।
গত ৬ জুন রাজউক বাদী হয়ে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ধারাসহ দণ্ডবিধির ধারায় উত্তরা পূর্ব থানায় মামলা দায়ের করে, যার মামলা নম্বর উত্তরা পূর্ব-০৪(০৬)২৫।
মামলার এজাহারনামীয় ২১নং আসামি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ‘নীলাভ নকশাঘর’-এর মালিক মো. জাহাঙ্গীর আলমসহ এজাহারনামীয় ২২ ও ২৩নং আসামি সজীব ও মুকুল উভয়কেই পুলিশ মতিঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করে।

Discussion about this post