শেখ শাফায়াত হোসেন : বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি) কর্মকর্তারা গত বৃহস্পতিবার কাজ ফেলে একটি অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলার জন্য সভায় বসেছিলেন। সেখানে তারা আইসিটি কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলতে আলাপ-আলোচনায় মিলিত হন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসের সার্ভারে ঘটে যায় দুর্ঘটনা। সময়মতো উদ্যোগ না নেওয়ায় ওই সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সার্ভারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে দেশের ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ প্রযুক্তিগত অনেক ধরনের সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই সার্ভার বন্ধের পেছনে দায়ী আইসিটি কর্মকর্তাদের অবহেলা। কারণ গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের দ্বিতীয় সংলগ্নী ভবনের ২৯ তলায় আইসিটি ল্যাবে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব আইসিটি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সেখানে তারা ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে অ্যাডহক কোর কমিটি চূড়ান্ত করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সঙ্গে চলমান পরিস্থিতি ও পদোন্নতির বিষয়টি নিয়েও আলোচনা হয়।
এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসে সার্ভারে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। তখন সেই দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রাজশাহী অফিসের সার্ভারে সমস্যা দেখা দেওয়ায় তা নিরসন না করায় মতিঝিল অফিসেও সমস্যা দেখা দেয়। দ্রুত সময়ে তা রক্ষণাবেক্ষণ না করায় পুরো সিস্টেমই ধসে পড়ে। ফলে বিকেলের দিকে সার্ভার ডাউন হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইট বন্ধ হয়ে যায়।
একইসঙ্গে ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ নানা ডিজিটাল সেবা বন্ধ হয়ে যায়। ওই দিন বিকেল ৪টার দিকে বিদ্যুৎ সমস্যা হওয়ার পর সার্ভার অচল হয়ে পড়ে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়।
এদিকে বিভিন্ন ব্যাংক গ্রাহকদের নোটিশ দিয়ে জানায় ‘প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রান্তে এনপিএসবি সেবা সাময়িকভাবে অকার্যকর রয়েছে। সিস্টেম দ্রুত পুনরায় চালু করার চেষ্টা চলছে। এই অসুবিধার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’
এর ফলে ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবায় ভোগান্তিতে পড়েন বহু গ্রাহক। সার্ভার ডাউনের প্রভাবে চেক ক্লিয়ারিং, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নিষ্পত্তি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। পাশাপাশি কার্ডভিত্তিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন পরিচালনার জন্য ব্যবহƒত ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ বাংলাদেশ (এনপিএসবি)-ও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গ্রাহকদের আন্তঃব্যাংক লেনদেন, অনলাইন পেমেন্ট ও বিভিন্ন ব্যাংকিং সেবায় জটিলতা দেখা দেয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গত বৃহস্পতিবার শেয়ার বিজকে বলেন, ’বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও ভোল্টেজের ফ্লাকচুয়েশনের কারণে পুরো সিস্টেম অফ হয়ে যায়। সার্ভার পুরোপুরি ঠিক করতে কাজ চলছে। আশা করছি খুব শিগগিরই সেবাগুলো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’
তবে গত শুক্রবার ও শনিবারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচ্চপর্যায়েরর কর্মকর্তারা সার্ভার ডাউন থাকার কারণ অনুসন্ধানে নামলে কর্মকর্তাদের অবহেলার বিষয়টি সামনে আসে। গতকাল শনিবার এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতিঝিল অফিসের কর্মকর্তাদের এ নিয়ে অনেককে ডেকে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
আরও জানা গেছে, গত দেড়-দুই মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইসিটি বিভাগের দুই নির্বাহী পরিচালকের মধ্যে কর্মপরিধি নিয়ে দ্বন্দ্ব বেধে রয়েছে। তাদের রেশারেশির কারণে সার্ভারের ত্রুটি নিরসনে সময়মতো পদক্ষেপ নেওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা শেয়ার বিজকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইসিটি বিভাগের দুই জন নির্বাহী পরিচালকের একজন মো, জাকির হুসাইন, আরেকজন দেব দুলাল রায়। এদের একজন হার্ডওয়ার এবং আরেকজন সফটওয়ারের বিষয়গুলো দেখেন। সার্ভারের ত্রুটি সময়মতো সারানোর সম্ভব না হওয়ার ক্ষেত্রে এই কর্মপরিধি বণ্টন নিয়ে রেশারেশি একটি কারণ হতে পারে বলেই আমরা জানতে পেরেছি।’
এদিকে সার্ভার অচল থাকায় কার্ডভিত্তিক আন্তঃব্যাংক লেনদেন, এটিএম বুথ থেকে টাকা উত্তোলন, এক ব্যাংক থেকে অন্য ব্যাংকে তাৎক্ষণিক ফান্ড ট্রান্সফার, অনলাইন পেমেন্ট এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পেমেন্ট নিষ্পত্তি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে।
মোবাইল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন ব্যাংকের আন্তঃব্যাংক লেনদেন হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জরুরি লেনদেনে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে টাকা পাঠাতে না পেরে কাজকর্ম বন্ধ
রাখতে বাধ্য হয়েছেন, আবার কেউ কেউ এটিএম থেকে অর্থ তোলাও করতে পারেননি। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এমন প্রযুক্তিগত বিপর্যয় বারবার ঘটায় গ্রাহকদের আস্থা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। দ্রুত সমস্যাটি সমাধান করে স্থায়ী সমাধানের দিকে যাওয়াই এখন সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রিন্ট করুন







Discussion about this post