মো. মাঈন উদ্দীন : ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার একটি লুটপাটের শিকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। সামনে ছিল অনেক চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। তবে চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে কিছুটা অগ্রগতি হলেও সম্ভাবনাকে এখনও কাজে লাগাতে পারেননি। বাকি সময় কতটুকু পারবেন তাও বলা কঠিন। হাঁটি হাঁটি পা পা করে গত এক বছরে সরকারের সাফল্য একে বারে কম নয়। রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বৈধপথে রেমিট্যান্স প্রবাহে রেকর্ড গড়া এবং খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচনে ফিরে এসেছে জনআস্থা। আর্থিক খাত সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সম্প্র্রতি একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে নেমে এসেছে এবং তা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আমানতকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, ‘পুরোপুরি পরিবর্তন হতে দুই থেকে তিন বছর সময় লাগতে পারে। তবে আমরা আশাবাদী, পরিবর্তন হবে— এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।’ আর্থিক খাত ঢেলে সাজাতে ‘নতুন ব্যাংক কোম্পানি আইন’ প্রণয়ন করা হচ্ছে এবং খসড়া ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। তার আশা, এই আইন পাস হলে ব্যাংকিং খাত একটি স্থিতিশীল ট্র্যাকে ফিরে আসবে এবং ভবিষ্যতে ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি ঘটবে না। অত্যন্ত আশাবাদী কথা তবে তা নির্ভর করবে আগামী দিনের রাজনৈতিক অর্থনীতির ওপোর। ব্যাপক লুটপাটের কারণে দেশের ব্যাংক খাত বিগত সরকারের আমলে খাদের কিনারে গিয়ে পৌঁছেছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে আওয়ামী আমলের লুটপাটের ঘটনা তদন্ত শুরু করলে ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে আসতে থাকে। বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে বেপরোয়া লুটপাটে সৃষ্ট ক্ষত কৌশলে আড়াল করে রাখা হতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকা ছাপিয়ে এ ক্ষতে প্রলেপ দেয়ার চেষ্টা ছিল। এতে বেড়েছে তারল্য ও ডলার সংকট; মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ঊর্ধ্বমুখী। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংক খাত থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে লোপাটকারীরা। এর বড় অংশই পাচার করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক সাত লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। আওয়ামী লীগের লুটপাটের কারণে সৃষ্ট সংকটে বর্তমান সরকারের এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। বিভিন্ন মিডিয়া ও বিশ্লেষকদের পর্যালোচনায় সরকারের এক বছরের সফলতা-ব্যর্থতার আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে অর্থনীতি, বিচার সংস্কার এবং মব ভায়োলেন্সের মতো ইস্যুগুলো। এক্ষেত্রে সরকারের সবচেয়ে বড় সফলতা কী এই প্রশ্নে অর্থনীতিতে ব্যাংক, বাজার, রিজার্ভসহ সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য সরকার কৃতিত্ব পাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির, মব ভায়োলেন্স, মৌলিক সংস্কার এমনকি বিচার প্রক্রিয়ার কিছু বিষয়ে সরকারের ভূমিকার নানা সমালোচনা করছেন পর্যবেক্ষক এবং বিশ্লেষকরা।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের সামনে সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন অনুষ্ঠান এই তিনটি বড় দায়িত্ব ছিল। এ ছাড়া ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতিকে সামাল দেয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল সরকারের সামনে। অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনা এবং বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার প্রশংসা রয়েছে। তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান কাঙ্ক্ষিত মানে না হওয়া এবং জ্বালানি ও শিল্প খাতে দুর্বলতার কথাও সামনে আনছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্তর্বর্তী সরকার বিগত পতিত সরকারের পেলে যাওয়া ধ্বংস প্রায় অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
এক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করা, সুদের হার একটা অবস্থায় রাখা, টাকার পতন আটকানো ইত্যাদি। এক্ষেত্রে সরকারের সাফল্য এসেছে কোনো সন্দেহ নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও সফলতা এসেছে। ১৪ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ নিয়ে শুরু করে এক বছরের ব্যবধানে তা উন্নীত হয়েছে ৩২ বিলিয়নে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি বকেয়া কোম্পানি বিল মেটানো, সবই এর অন্তর্ভুক্ত। অর্থনীতির আরেকটি চাঙ্গা সূচক হিসেবে রেমিট্যান্স প্রবাহের কথা উল্লেখযোগ্য। গড়ে প্রতি মাসে ২৫০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স দেশে আসছে। এর পেছনে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপগামী শ্রমবাজারে সরকারি হস্তক্ষেপ এবং হুন্ডি রোধে ডিজিটাল রেমিট্যান্স চ্যানেলের সম্প্রসারণ।
বাংলাদেশের অর্থনীতি এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বস্তুত দেশের ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো চিহ্নিত; কী করণীয় তা-ও বহুল আলোচিত। সমস্যাগুলো খতিয়ে দেখে সমস্যার সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। খেলাপি ঋণ সমস্যা ব্যাংক খাতের জন্য বড় দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিগত সরকারের আমলে কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দেয়া সত্ত্বেও খেলাপি ঋণ না কমে কেন অব্যাহতভাবে বেড়েছিল, তা-ও খতিয়ে দেখতে হবে। যেহেতু খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে দুরারোগ্য ব্যাধির রূপ নিয়েছে, সেহেতু এ খাতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। এ খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যও নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। ব্যাংক খাতের সব সংকট দূর করার জন্য দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। কাজেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হবে, পরবর্তী সরকারের আমলেও সেগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। অর্থনীতির সঙ্গে জড়িত ঘুস, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, প্রশাসনিক অদক্ষতাসহ দেশের অনেক মৌলিক সংকট আগের মতোই বিরাজমান। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের যেসব প্রতিশ্রুতির কথা শোনা গিয়েছিল, তার অনেকগুলোই গত এক বছরে আলোর মুখ দেখেনি। আর্থিক এ বেহাল পরিস্থিতির মধ্যে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম হলেও সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা বেশি। ঘোষিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। আর তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের বেশি থাকা মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণাও দেয়া হয়।
যদিও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যকে গৌণ মনে করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য নীতি সুদহার (রেপো রেট) বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছিল। এর প্রভাবে ব্যাংক ঋণের সুদহার উঠে গেছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশে। প্রত্যাশা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির লাগামও টানা যায়নি। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিবিএস। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা ও তথ্য বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, কর্মসংস্থানের অভাব ও বেকারত্বের প্রভাবে গত এক বছরে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। এ সময়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নেও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। দখল ও চাঁদাবাজির মতো ঘটনা প্রতিদিনই সংবাদ হচ্ছে। বরং কিছু ক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আগের চেয়ে বেশি হারে চাঁদা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানের মতে, ‘গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে অনেক সুযোগ এসেছিল। কিন্তু আমরা এরই মধ্যে সে সুযোগগুলো হারিয়েছি। এ সুযোগ আর পাওয়া যাবে কিনা, তা নিয়ে আমি সন্দিহান।’ বিশ্লেষকদের মতে সরকারের অভ্যন্তরে প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে কাজের গতি। সচিবালয়ের পাশাপাশি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমেও মন্থরতা বিরাজ করছে। ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি অনেক অপব্যয়ও রোধ করতে পারেনি সরকার। গত এক বছরে শিক্ষার মান উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর কোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। উল্টো ‘মব’ কালচার বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে শিক্ষার্থীরা আরো বেশি ক্লাসবিমুখ হয়েছে। ব্যর্থ হয়েছে সড়কে বিশৃঙ্খলা রোধ ও দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে। আগামী দিনের অর্থনীতিকে টেকসই ও গতিশীল করতে হলে রাজনৈতিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে হবে। পরমত সহিষ্ণু হতে হবে। গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি দিন (৫ আগস্ট) জাতির উদ্দেশে নেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগামী ফেব্রুয়ারিতে রমজানের আগে নির্বাচন দেয়ার কথা জানিয়েছেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, নির্বাচনের নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার নির্বাচন নিয়ে ঘোষণার মধ্যে দিয়ে দূর হয়েছে। এখন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি, সবার জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ।
পাশাপাশি জুলাই ঘোষণাপত্র, জুলাই সনদদের আইনি ভিত্তি দেয়া এবং জুলাই গণহত্যার বিচার কার্যক্রম দৃশ্যমান করা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন রাজনৈতিক দলগুলো। সংস্কারও চব্বিশ এর গণহত্যার বিচার না করে নির্বাচনের ট্রেনে যাত্রা কিন্তু সুসম অর্থনীতির জন্য আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
ব্যাংকার, মুক্ত লেখক
main706@gmail.com.

Discussion about this post