নিজস্ব প্রতিবেদক : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মানবাধিকার রক্ষা তো দূরের কথা, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হতো। আইনেও ছিল নানা সীমাবদ্ধতা বলে মন্তব্য করেছেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
কক্সবাজারের উখিয়ার ইনানীতে অবস্থিত বেওয়াচ হোটেলের সম্মেলন কক্ষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০০৯ এর সংশোধনবিষয়ক পরামর্শ-কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে গতকাল শনিবার তিনি এ কথা বলেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার রক্ষায় একটি মাইলফলক স্থাপন
করে দিয়ে যেতে চায়। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের এত শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতায় আমরা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব।’
ইউএনডিপির সহায়তায় আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় অংশীজনদের নিয়ে এই পরামর্শক সভার আয়োজন করেন।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে স্বাধীন করতে চায়। এই কমিশন গুম-খুনসহ যেকোনো মানবাধিকার হরণের ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে পারে সে বিষয়ে আইন সংস্কার করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠানে রূপ দিতে চায়।’
আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘একটি শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন না থাকা বা করতে না পারলে কি হয়, সেটা আওয়ামী লীগ আমলের ১৫ বছরে দেখা গেছে। উচ্চ আদালত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পক্ষের শক্তি হিসেবে হাজির হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকার রক্ষা তো দূরের কথা মানবাধিকার হরণের কাজে লিপ্ত ছিল। বিগত সরকারের সময় মানবাধিকারের কর্তা ব্যক্তিরা যারা ছিল তারা দেশে ও দেশের বাইরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের পক্ষে বিভিন্নভাবে বক্তব্য রেখেছেন। বর্তমান সরকার ভালো একটি আইন করে দিয়ে যেতে চায়। আশা করা যায় ভালো একটি আইন করে দিয়ে যেতে পারবে সরকার। কারণ, এই সরকারের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি স্মৃতি রয়েছে।’
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে শিল্প ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘দীর্ঘ ১৫ বছরের গুম, খুন ও আয়নাঘর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিগত সময়ে মানবাধিকার কর্মীদেরকেই গুম করা হতো। টর্চার ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের ওপর নির্যাতন করা হতো।’
তিনি বলেন, ‘মানবাধিকার কমিশনকে বিগত সময়ে ডোনার ফান্ড খরচ করে কিছু লোককে চাকরি-বাকরি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে এই মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। তাদের কমিশনাররা চলে গেলেও কর্মকর্তা-কর্মচারী, যাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরি হয়েছিল তারা এখনও রয়ে গেছে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গুম হওয়ার পর যারা এখনও ফিরে আসেনি তাদের ব্যাপারে যেন তদন্ত করতে পারে সেই ব্যবস্থা থাকতে হবে কমিশনে।’
তিনি বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার মানবাধিকার কমিশনকে এমনভাবে সংস্কার করবে যাতে কমিশন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা, গুম খুনের ঘটনা স্বাধীনভাবে তদন্ত করার ক্ষমতা থাকে। গত সাড়ে ১৫ বছরে যে দুঃশাসন, আয়নাঘর, নির্যাতন, গুম হয়ে যাওয়া বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে যা হয়েছে তা যেন আর না হয়। সে জন্য অন্যরকম একটি প্রতিষ্ঠানে যেন মানবাধিকার কমিশনকে রূপান্তরিত করা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বর্তমান সরকার।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের বিশেষ পরামর্শক ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। বক্তব্য দেন ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার, বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেটু সিগফ্রিড রেংগলি, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত হি. ই. নিকোলাস উইকস ও জোরপূর্বক গুমবিষয়ক অনুসন্ধান কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী প্রমুখ।
সভায় বলা হয়, মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ (২০০৯ সনের ৫৩ নং আইন) রহিত করে নতুনভাবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ ২০২৫ প্রণয়নের ড্রাফট নিয়ে কাজ করছে সরকার।
প্রস্তাবিত এই অধ্যাদেশে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হিসেবে কমিশনকে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও চাকরিজীবীদের বিরুদ্ধেও স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে।
এছাড়া গুম ও খুন প্রতিরোধে আলাদা আইন প্রণয়নের বিষয়টিও ড্রাফটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এজন্য আলাদা ক্ষমতাও দেয়া হবে কমিশনকে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ প্রণীত হলে এই সরকারের আমলেই তা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হবে।

Discussion about this post