ফারুক রহমান, সাতক্ষীরা
সুন্দরবনের পাড়ঘেঁষা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায় এক নতুন সম্ভাবনার নাম ‘সফটশেল’ কাঁকড়া। সুন্দরবনের ছায়াতলে জš§ নেয়া নরম খোসার কাঁকড়া এখন এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে বিপুল জনপ্রিয়তা
পেয়েছে। চিংড়িনির্ভরতা কমে গিয়ে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কাঁকড়ার চাষাবাদ।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চাষযোগ্য কাঁকড়ার মধ্যে শিলা কাঁকড়া অন্যতম। শিলা কাঁকড়া খোলস বদলের সময় প্রায় তিন ঘণ্টা খোলসবিহীন থাকে। তখন কাঁকড়ার ওপর শুধু একটি নরম আবরণ
থাকে। ঠিক সেই সময় কাকড়াঁগুলো বিক্রির জন্য উপযুক্ত হয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে সফটশেল (নরম খোসা) কাঁকড়ার উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়, যার কারণে অনেক চাষি চিংড়ি ছেড়ে এখন কাঁকড়া চাষে ঝুঁকছেন। লাভ বেশি হওয়ায় চাষিরা এখন চিংড়ি চাষ ছেড়ে কাকড়াঁয় আগ্রহ দেখাচ্ছেন বেশি। বর্তমানে শ্যামনগর ছাড়াও সদর ও কালীগঞ্জ উপজেলাসহ অন্যান্য স্থানেও সফটশেল কাঁকড়া চাষ হচ্ছে।
কাঁকড়া চাষে পুকুরের পানির উপরিস্তর ব্যবহƒত হয়, যাতে অব্যবহƒত থাকে পানির নিচের স্তর। পুকুরের পানির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাঁকড়ার পাশাপাশি সাদা মাছ যেমন রুই, কাতলা ও তেলাপিয়াসহ নানা মাছ চাষ করে লাভবান হচ্ছেন অনেক চাষি। সফটশেল কাঁকড়া সাধারণত খাঁচা পদ্ধতিতে চাষ হয়, যাতে পানির ওপরে খাঁচাগুলোতে কাঁকড়া চাষ করলে নিচের স্তরের পানিতে সাদা মাছের চাষ করা যায়।
সফটশেল কাঁকড়া দ্রুত প্রক্রিয়াজাত ও রান্না করা যায় বলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর চাহিদা বেশি। বর্তমানে সফটশেল কাঁকড়া চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন এশীয় দেশে রপ্তানি হচ্ছে।
কাঁকড়া শুধু সাতক্ষীরার মানুষের আয়েরই উৎস নয়, বরং কাঁকড়া চাষের মাধ্যমে এই অঞ্চলে মানুষের বেকারত্বও দূর করছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এই কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
সরেজমিনে শ্যামনগর উপজেলার কয়েকটি কাঁকড়ার খামারে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি কাঁকড়ার খামারে কর্মব্যস্ত দিন কাটাচ্ছেন নারী ও পুরুষরা। কেউ ছোট ছোট করে কাটছেন কাঁকড়ার খাবার তেলাপিয়া মাছ এবং কেউ কেউ নিয়ম করে দেখছেন কাঁকড়ার খোলস পাল্টাচ্ছে কি না। নারীরা মাছ কেটে কাঁকড়ার খাবার তৈরি করেন, আর পুরুষরা খাঁচায় ছাড়েন কাঁকড়া। প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করেন এসব খামারে। ফলে উপকূলীয় জনপদে গড়ে উঠছে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ।
শ্যামনগর উপজেলার কলবাড়ী গ্রামের সেলিম হোসেন একসময় ছিলেন নদীনির্ভর জেলে। প্রতিদিন সুন্দরবনের খাল আর আশপাশের নদীতে কাঁকড়া ধরে চলত তার সংসার। কিন্তু অনিশ্চিত আয়ের কারণে পরিবার নিয়ে ছিলেন দারিদ্র্যের ঘেরাটোপে। সময়ের সঙ্গে পাল্টে গেছে তার জীবন। এখন তিনি সফল সফট শেল কাঁকড়াচাষি। জেলে থেকে উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার এই রূপান্তরের গল্প আজ এলাকার অনেকের অনুপ্রেরণা।
সেলিম হোসেন বলেন, আগে প্রতিদিন নদীতে কাঁকড়া ধরেই সংসার চালাতে হতো। এখন নিজের খামারে কাজ দিচ্ছি স্থানীয় ছেলেদের। এ চাষই বদলে দিয়েছে আমার ভাগ্য। তার খামারে কাজ করছেন বেশ কয়েকজন স্থানীয় যুবক। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি এলাকায় নতুন উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহও বাড়ছে।
শ্যামনগরের দুগাবাঁটি এলাকার কাঁকড়া চাষি গৌতম সরকার বলেন, ‘আমাদের এখানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে থাকে। তাই আমাদের অর্থনৈতিক একটা ঝুঁকি সব সময় থাকে। চিংড়ি পোনার লবণাক্ততা সহ্য করার ক্ষমতা কম এবং পোনায় ভাইরাসের আক্রমণে এটি মারা যায়। তাই আমি এবার কাঁকড়া চাষ করেছি। এতে তুলনামূলকভাবে লাভ বেশি হয়। কাঁকড়ার পাশাপাশি পুকুরে সাদা মাছ চাষ করছি, যাতে এটি থেকেও আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হওয়া যায়।
একই এলাকার চাষি সৌরভ সরকার বলেন, ‘আমাদের এই অঞ্চলের সবাই সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। আমি এই মৌসুমে ৭০০ খাঁচায় তৈরিতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকা। বাজার ভালো থাকলে পাঁচ থেকে ছয় লাখ টাকা বিক্রি করতে পারব। বর্তমানে ‘এ’ গ্রেডের সফটশেল কাঁকড়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭৫০ টাকা, ‘বি’ গ্রেডের ৬৫০ টাকা, আর ‘সি’ গ্রেডের ৫০০ টাকা দামে।’
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে জুন মাসে কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ মার্কিন ডলার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই-জুন) এ রপ্তানি ছিল ৯২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, এতে বিগত বছরে চেয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। শুধু গত জুন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ডলার।
জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শ্যামনগরে ৩৬৪ চাষি প্রায় ৩২১ হেক্টর জমিতে সফটশেল কাঁকড়া চাষ করছেন। বছরে উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন কাঁকড়া, যার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্য ৬০০ কোটি টাকা। গত বছর সফটশেল কাঁকড়া রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৮ লাখ ২২ হাজার ডলার। আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে সাতক্ষীরার এ কাঁকড়া।
স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল্লাহ আল কায়ূম আবু বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে সাতক্ষীরার কাঁকড়ার মান খুব ভালো। আমরা চাহিদা মেটাতে পারলে আরও বেশি রপ্তানি করা সম্ভব। একসময় চিংড়িই ছিল সাতক্ষীরার অর্থনীতির মূল ভরসা। তবে বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে গেলে বিকল্প খুঁজতে শুরু হয়। ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিকের খাঁচায় সফটশেল কাঁকড়া চাষ শুরু হয়। এখন সেটিই রূপ নিয়েছে একটি সমৃদ্ধ শিল্পে।
সাতক্ষীরা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জিএম সেলিম বলেন, দেশে-বিদেশে সফটশেল কাঁকড়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। যদি স্থানীয়ভাবে হ্যাচারি স্থাপন করা যায়, তাহলে এ শিল্প আরও বড় পরিসরে সম্প্রসারিত হবে এবং বৈদেশিক আয়ও বহুগুণে বাড়বে। তিনি বলেন, শ্যামনগর উপজেলার মাত্র দুটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৩৬৫টি বাণিজ্যিক খামার। বছরে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় দুই হাজার টন কাঁকড়া, আর কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষের।
প্রিন্ট করুন






Discussion about this post