Print Date & Time : 13 December 2025 Saturday 3:12 am

সাবেক চেয়ারম্যান-এমডিসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা

নিজস্ব প্রতিবেদক : ক্ষমতার জোরে জালিয়াতির মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের একটি বিতর্কিত শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। অভিযোগে বলা হয়, বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে ভুয়া নথিপত্র তৈরি করে। জামানত হিসেবে রাখা সম্পত্তির অবিশ্বাস্য মূল্য এবং বিধিবহির্ভূতভাবে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনসহ নানা জালিয়াতির মাধ্যমে।

এই প্রক্রিয়ায় জনতা ব্যাংকের শীর্ষ নীতিনির্ধারক থেকে শুরু করে শাখা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সরাসরি সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অবিশ্বাস্য এই জালিয়াতির ঘটনায় ওই ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার, তিন ভাই, পরিবারের সদস্য এবং জনতা ব্যাংকের সাবেক দুই চেয়ারম্যান ও এমডিসহ মোট ৩৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগের পরিচালক মো. আবুল হোসেন গতকাল বুধবার এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি জানান, সংস্থার উপপরিচালক মো. সিরাজুল হক বাদী হয়ে গত ৭ ডিসেম্বর দুদকের চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এ মামলাটি দায়ের করেন। এজাহারে মোট ১ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৫৯ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯, ৪২০ ও ১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ৪(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

মামলায় ওই গ্রুপের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আসামি হয়েছেন তার তিন ভাইÑগ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল আলম, এস আলম ট্রেডিংয়ের পরিচালক মো. ওসমান গনি এবং সোনালী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. শহিদুল আলম। এছাড়া ওসমান গনির স্ত্রী ফারজানা বেগমও মামলার দ্বিতীয় আসামি। জালিয়াতিতে সহায়তা করা নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের মধ্যে এনএন ইন্সপেকশন সার্ভিসেসের ম্যানেজিং পার্টনার খন্দকার রবিউল হক, কমোডিটি ইন্সপেকশন সার্ভিসেসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক  খন্দকার জহিরুল হক এবং গ্লোবাল ট্রেডিং করপোরেশনের পরিচালক আবদুস ছবুরকে আসামির তালিকায় রাখা হয়েছে।

মামলার এজাহারে জনতা ব্যাংকের ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা কীভাবে ধাপে ধাপে এ অনিয়মে জড়িয়েছেন তা উঠে এসেছে। আসামিদের তালিকায় রয়েছেন জনতা ব্যাংকের সাবেক দুই চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ ও ড. এস এম মাহফুজুর রহমান। সাবেক পরিচালক খন্দকার সাবেরা ইসলাম, মো. আবুল কাশেম, অজিত কুমার পাল, কে এম সামছুল আলম, মো. আসাদ উল্লাহ, জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ড. শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ, মো. আব্দুল মজিদ ও বেগম রুবীনা আমীনকেও আসামি করা হয়েছে। ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ, সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল জব্বার, মো. ইসমাইল হোসেন, মো. তাজুল ইসলাম এবং শেখ মো. জামিনুর রহমানও মামলার আসামি।

মাঠপর্যায় ও প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে আসামি হয়েছেনÑচট্টগ্রাম সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখার সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. সিরাজুল করিম মজুমদার ও মো. আবুল মনসুর, আগ্রাবাদ বিভাগীয় কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল আহসান ও মো. আশরাফুল আলম। ঢাকা প্রধান কার্যালয়ের সাবেক মহাব্যবস্থাপক মো. মাসফিউল বারী, এসএম আব্দুল ওয়াদুদ, মো. শামীম আলম কোরেশী, মো. মিজানুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান খান এবং সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক মো. শহীদুল হকের নামও এজাহারে রয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, ২০১০ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত সুদ-আসলে মোট ১ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫৪ লাখ ৬১ হাজার ৫৫৯ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এর মধ্যে সিসি (হাইপো) হিসাবে ২৫৪ কোটি ৭৯ লাখ টাকা, ৯টি এলটিআর হিসাবে ২৩৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা এবং ৫২টি পিএডি হিসাবে ১ হাজার ৪৭০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে আরও বলা হয়েছে, ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় জালিয়াতি হয়েছে অর্থের গন্তব্য নিয়ে। এলটিআরের (লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিপ্ট) শর্ত অনুযায়ী, নিজস্ব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এস আলম গ্রুপ এই শর্ত লঙ্ঘন করে নিজেদের এক প্রতিষ্ঠান থেকে আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে পণ্য আমদানির নাটক সাজিয়েছে। ব্যাংকের কর্মকর্তারা বিষয়টি জানলেও নীরব ছিলেন। প্রথম ৯টি লোকাল এলসির মধ্যে ৪টির পেমেন্ট যায় মেসার্স সোনালী ট্রেডার্সের অনুকূলে এবং ৫টির পেমেন্ট যায় এস আলম ট্রেডিং কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের অনুকূলে পে-অর্ডারের মাধ্যমে। উভয় প্রতিষ্ঠানই একই গ্রুপভুক্ত। অর্থাৎ ব্যাংকের টাকা পে-অর্ডারের মাধ্যমে ঘুরেফিরে এক পরিবারের পকেটেই গেছে।

ঋণের বিপরীতে জামানত বা বন্ধকি সম্পত্তি মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের কারচুপি করা হয়েছে। রেকর্ডপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, মর্টগেজ নেওয়ার সময় ব্যাংক কর্মকর্তারা সম্পত্তির বাজারমূল্য দেখিয়েছিলেন ৪২৪ কোটি ৪০ লাখ টাকা। অথচ দুদকের অনুরোধে গঠিত পুনর্মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদনে সেই সম্পত্তির বর্তমান বাজারমূল্য পাওয়া গেছে মাত্র ২৪৯ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তারা অসৎ উদ্দেশ্যে অতিমূল্যায়ন করে এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম জামানত নিয়ে হাজার কোটি টাকার ঋণ ছাড় করেছেন।

আরও উল্লেখ করা হয়েছে, জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন করপোরেট শাখার কর্মকর্তারাই জালিয়াতির ভিত্তি তৈরি করেন। ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড উভয় প্রকার দায়ে সীমাতিরিক্ত ঋণ সৃষ্টি করা হয়। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী জাহাজি দলিল হস্তান্তরের আগে নির্ধারিত মার্জিন আদায় বাধ্যতামূলক হলেও শাখা কর্মকর্তারা কোনো মার্জিন ছাড়াই এলটিআর দায় সৃষ্টি করেন। প্রতিটি এলটিআরের বিপরীতে পৃথক চার্জ ডকুমেন্ট, ট্রাস্ট রিসিপ্ট বা চেক নেওয়া হয়নি। গ্রাহকের গুদামে রাখা পণ্যের ঝুঁকির বিপরীতে বীমা করার নিয়ম থাকলেও তা করা হয়নি। শাখা ব্যবস্থাপক ও বিভাগীয় প্রধানরা ঋণ নবায়নের সময় ভুয়া সুপারিশ প্রধান কার্যালয়ে পাঠিয়েছেন।

ঋণ নবায়ন ও বর্ধিতকরণের সময় প্রধান কার্যালয়ের ক্রেডিট কমিটি ও পরিচালনা পর্ষদ গুরুতর অনিয়ম করেছে। ২০১৯ এবং ২০২২ সালে ঋণের সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব বোর্ডে উঠলে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী শাখা থেকে সেই পর্যবেক্ষণের জবাব পাওয়ার পরই অনুমোদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তৎকালীন পরিচালনা পর্ষদ ও ক্রেডিট কমিটি পরস্পর যোগসাজশে শাখার জবাবের অপেক্ষা না করে তড়িঘড়ি করে ঋণ অনুমোদন দেয়।

এজাহারে বলা হয়েছে, পরিচালনা পর্ষদ যদি যথাযথ যাচাই-বাছাই করত এবং প্রস্তাবটি নাকচ করত, তবে এই বিপুল অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হতো না। তদন্তকালে এই জালিয়াতির সঙ্গে অন্য কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছে দুদক।