নিজস্ব প্রতিবেদক : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক তিন গভর্নর ও ছয় ডেপুটি গভর্নরের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সবার অ্যাকাউন্টের তথ্য তলব করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করা তিন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান, ফজলে কবির ও আব্দুর রউফ তালুকদারের ব্যাংক হিসাবের তথ্য চেয়ে ব্যাংকগুলোয় চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ।
ব্যাংক হিসাব তলব করা সাবেক ছয় ডেপুটি গভর্নর হলেনÑসিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী (এসকে সুর নামেও পরিচিত), মাসুদ বিশ্বাস, এসএম মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান, কাজী ছাইদুর রহমান ও আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাত ধ্বংসের মুখে পড়ে। এর মধ্যে সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সময়কালে কেন্দ ীয় ব্যাংকের তদারকিতে ছিল দুর্বলতা। এ সুযোগে সোনালী ব্যাংকে হলমার্ক ও বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। আবার তার সময়েই ২০১৫ সালে বেক্সিমকোর কর্ণধার সালমান এফ রহমানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয় কেন্দ ীয় ব্যাংক।
আতিউর রহমানের সময় সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি। রিজার্ভ চুরির ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টাও করেছিলেন তিনি। এ ঘটনার পরই তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
এরপর কেন্দ ীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেন সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবির। তার মাধ্যমেই ২০১৭ সালের শুরুতে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ এবং পরে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক দখল করে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপ। সে সময় ব্যাংকগুলো থেকে বড় অঙ্কের ঋণের নামে অর্থ বেহাত হয়ে যায়।
এ ছাড়া ঋণ নীতিমালায় ছাড় দিয়ে খেলাপি ঋণ গোপন করা, সুদের হার ৯ শতাংশে আটকে রাখা এবং নামমাত্র টাকা দিয়ে খেলাপি থেকে মুক্ত থাকার পদ্ধতি চালু হয় তার আমলে। ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে অনেক ব্যবসায়ী এসব টাকা বিদেশে পাচার করেন।
ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষে আরেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হন। দুই বছরের মাথায় তিনি যত বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল সব নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গোপন স্থান থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। তার আমলেও আগের মতো বেনামে ঋণ ও জালিয়াতি করে ঋণ বিতরণের ধারা অব্যাহত থাকে। তিনি অনিয়ম বন্ধে উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হন। পরে অনিয়মে যুক্ত ব্যবসায়ীদের সহযোগী হয়ে পড়েন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তিনি এসেই ঋণখেলাপিদের বড় ছাড় দিয়ে নতুন এক নীতিমালা জারি করেন। আবার তার সময়েই এস আলমের ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাপিয়ে দেয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাবেক এ তিন গভর্নর। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, হাসিনার পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে যান আতিউর। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তার পাসপোর্ট ব্লক করেছে সরকার। ফজলে কবির দেশেই রয়েছেন, তবে হাসিনার পতনের পর তাকে জনসম্মুখে দেখা যায়নি। আর ৫ আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুর রউফ। তিনি দেশে আছেন।
তাদের মধ্যে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও বিএফআইইউর সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বর্তমানে দুদকের মামলায় জেলহাজতে আছেন। জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামান দায়িত্ব পেয়ে ব্যাংকগুলোর পরিদর্শন বন্ধ করে দেন।
বিএফআইইউয়ের সাবেক প্রধান রাজী হাসানের সময়ে অর্থপাচার হলেও তিনি প্রতিরোধে কোনো ব্যবস্থা নেননি। অভিযোগ রয়েছে, ডলার বাজারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেন কাজী ছাইদুর রহমান এবং ঋণ নীতিমালা শিথিলের মাধ্যমে পুরো ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেন আবু ফরাহ মোহাম্মদ নাছের।

Discussion about this post