সাধন সরকার : সিসা নীরব ঘাতক। প্রতিদিনকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় কখন যে সিসার বিষ শরীরে প্রবেশ করছে তা বুঝে উঠা মুশকিল! সিসা দূষণের প্রধান উৎস পুরোনো ও পরিত্যক্ত ব্যাটারি থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সিসা আহরণ প্রক্রিয়া। সব বয়সী মানুষ সিসা দূষণের শিকার। তবে উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের অর্ধেকের বেশি শিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অতি সম্প্র্রতি প্রকাশিত ‘আইসিডিডিআর,বির’ গবেষণা প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে, রাজধানীর ৯৮ শতাংশ শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পরিচালিত গবেষণায় সিসা দূষণের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা তুলে ধরা হয়। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)-এর সঙ্গে মিলে ইউনিসেফের আরেক গবেষণায় ওঠে এসেছে, দেশের ৬০ শতাংশ শিশু (৩ কোটি ৬০ লাখ) রক্তে উচ্চমাত্রায় ক্ষতিকর সিসার বিষ বয়ে বেড়াচ্ছে। এদের মধ্যে এক কোটি শিশুর রক্তে প্রতি ডেসিলিটারে ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি সিসা পাওয়া গেছে। এছাড়া দুই থেকে চার বছর বয়সি শতভাগ শিশুদের শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ‘গ্লোবাল হেলথ বার্ডেন অ্যান্ড কস্ট অব লেড এক্সপোজার ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টস: এ হেলথ ইমপ্যাক্ট অ্যান্ড ইকোনমিক মডেলিং অ্যানালাইসিস’ শিরোনামে দ্য ল্যানসেট জার্নালে ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসার দূষণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ১ লাখ ৩৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ-বিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা সেন্টার ফর ডিডিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) তথ্য মতে, শরীরে সিসার সহনীয় মাত্রা ৩ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম। কারও শরীরে এর বেশি সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেলে তা ক্ষতিকর বলে ধরা হয়। ইউনিসেফ ও পিওর আর্থ প্রকাশিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়, সিসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ শিশু। সিসার দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে খারাপ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
উদ্বেগের বিষয়টি হলো, সিসা দূষণের উৎসগুলো অনেক সময় অজানাই থেকে যায়! আবার উৎসস্থল জানা থাকলেও দূষণ থেকে মুক্তি মেলে না। বাজারে, বাসাবাড়ির পাশে, ক্ষেতের পাশে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশেসহ যত্রতত্র ব্যাটারি তৈরি ও ভাঙারির দোকান গড়ে উঠেছে। এসব স্থানে প্রতিনিয়ত শিশুসহ সর্বসাধারণের চলাচল রয়েছে। বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, সিসা কারখানায় যারা কাজ করেন তারা মাস্ক, গ্লাভস ও অন্য কোনো সুরক্ষা সামগ্রীও ব্যবহার করেন না! ঠিক এ কারণেই তাদের শরীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে সিসা প্রবেশ করছে। এমনকি এই ক্ষতিকর পদার্থ দ্বারা তার পরিবারের সদস্য ও আশপাশের লোকজনও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।
সিসা যে শুধু পুরোনো ব্যাটারির কারখানা থেকে ছড়াচ্ছে তা নয়। আইসিডিডিআরবি’র গবেষণায় ইলেকট্রনিক্স বর্জ্য, গহনা প্রস্তুত, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, ব্যবহƒত রং, সিরামিকস, শিশুদের খেলনা, সবজি, চাল, মসলা, পানির পাইপ, কসমেটিকস, কোমল পানীয়র ক্যান, হার্বাল ওষুধ, পোড়ামাটি, ছাই, হলুদের গুঁড়া, সিঁদুরের গুঁড়া, মাছ ধরার জাল, দেয়ালের রংসহ ৯৬ ধরনের পণ্যে সিসার নমুনা মিলেছে। এসব উপাদান থেকে খাদ্য, পানি ও ত্বকের মাধ্যমে সিসা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানবদেহে প্রবেশ করছে। রঙের প্রলেপ দেয়া বিভিন্ন শিল্পকর্মে সিসার মারাত্মক উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। ক্রেতাকে আকর্ষণ করার জন্য অনেক ব্যবসায়ী হলুদ ও মরিচের গুড়ায় সিসা মিশিয়ে থাকেন বলে গবেষণায় ওঠে এসেছে।
গর্ভবতী মায়েদের জন্য সিসা আরও ভয়াবহ। গবেষণায় গ্রামের ৩০ শতাংশ মহিলার শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। গর্ভবতী নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি গর্ভের ভ্রুণের সমস্যা, অপরিণত শিশুর জš§ ও প্রতিবন্ধী শিশুর জš§ দেয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। এছাড়া এটি পাইলস, ফিস্টুলা, আলসার, লিভার ও কিডনি জটিলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমাদের মতো দেশে সিসাযুক্ত অ্যাসিডক পুরোনো ব্যাটারি অবৈধ রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে উঠেছে। যারা এই কারখানা গড়ে তুলেছে তারাও এর ভয়াবহ ক্ষতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়! ফলে তারা তো শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আবার আশপাশের উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতেরও ক্ষতিসাধন করছে। কারখানায় মূলত পুরোনো ব্যাটারির খোলস ভেঙে উš§ুক্ত করা হয়। অতঃপর অপরিশোধিত সিসা উš§ুক্ত চুল্লিতে গলানো হয়। ফলে বিষাক্ত ধোঁয়া আশপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া বিষাক্ত সিসা উš§ুক্ত ও গলানোর সময় মাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে। পুরোনো যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিসার অ্যাসিডের অনিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহার বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিসার দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে শিশুদের। শিশুর বিকাশমান মস্তিষ্কে সিসার প্রভাব ভয়াবহ। সিসার প্রভাবে আসা শিশুর মধ্যে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দেয়। মস্তিষ্কের আইকিউ কমার অনেকগুলো কারণের একটি হলো সিসা দূষণ। শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ দুটোই বাধাগ্রস্ত হয় এই দূষণের ফলে। কোনো কিছু শেখার ক্ষেত্রে তারা যেমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে আবার তাদের আচরণে দেখা দিচ্ছে নানা রকম অসঙ্গতি। এছাড়া মেজাজ খিটখিটে হওয়া, ওজন কমে যাওয়া, খাবারে অরুচিসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। মনোযোগ নষ্ট হওয়ার ফলে শিশুর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ারও ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন সিসা দূষণের মধ্যে থাকা শিশুর মধ্যে আগ্রাসী মনোভাব তৈরি হয়। যা পরবর্তী সময়ে তাকে অপরাধ জগতে প্রবেশ করতে ভূমিকা রাখে।
সিসা মূলত এক ধরনের মারাত্মক নিউরোটক্সিন, যা মস্তিষ্কের বিষাক্ত পদার্থ হিসেবে বিবেচিত। সিসা খালি চোখে দেখা যায় না, এমন কী এর গন্ধও পাওয়া না। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে তা আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে। সিসা দূষণের কবলে পড়া শিশু যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন তার মধ্যে শারীরিক, মানসিক ও স্নায়ুবিক ক্ষতির ঝুঁকি থেকে যায়। এটি প্রাপ্ত বয়স্কদের হƒদরোগের বড় কারণ।
সিসা একবার মানবদেহে প্রবেশ করলে তা আর বের হয় না। সিসা মূলত মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে। গবেষণার তথ্য মতে, সিসা দূষণের আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশের জিডিপির একটা বাজেটের ৭ শতাংশের বেশি। শৈশব থেকে শিশুর জীবনভর দূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতি বিবেচনায় নিলে এই ক্ষতিটা এককথায় অপূরণীয়। মাটি, পানি ও বায়ুতে সিসার উপস্থিতি কোনো না কোনোভাবে খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। সিসা কারখানার চুল্লির ধোঁয়ায় ক্ষেতের ফসল শুকিয়ে যায়। এমনকি সিসা কারখানার পাশের ফসল ও ঘাস খেলে গরু-ছাগলেরও ক্ষতির ঝুঁকি থাকে।
বেশিরভাগ সিসা কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। স্থানীয় প্রশাসনের ম্যানেজ করেই চলছে এসব কারখানা। ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধিত) আইন-২০১০’ এ ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবহারে বিধি-নিষেধ থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। আইন আছে আইনের জায়গায়। আইনের তোয়াক্কা না করে যে যার মতো করে সিসা প্রক্রিয়াজাত করছে। অবশ্য এমন আইন আছে তা অনেকেই জানে না। কর্তৃপক্ষ থেকে অবৈধ সিসা কারখানার বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও তা খুবই সীমিত।
২০৪০ সালের মধ্যে সিসামুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার রয়েছে। তাই দূষণ বন্ধে জাতীয় উদ্যোগ দরকার। সিসা দূষণের উৎস শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। শহর বা জনবহুল স্থান থেকে সিসা কারখানা সরাতে হবে। সিসামুক্ত ব্যাটারি ও সিসামুক্ত পণ্য ব্যবহার করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া দূষণ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। দেশের অর্ধেকের বেশি শিশু সিসা দূষণের শিকারÑ এটা দেশের জন্য একটা ভয়াবহ দুসংবাদ। সিসা দূষণ বন্ধে এখনই পদক্ষেপ না নিলে শিশুদের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারে- একথা নিশ্চিত করে বলা যায়। দূষণ রোধে দূষণের উৎসগুলো শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দূষণ রোধ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতিমালা দরকার। সিসার আমদানি ও ব্যবহারে হ্রাস টানতে হবে। এছাড়া পুরাতন সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির রিসাইক্লিং অপরিকল্পিত কারখানা নজরদারিতে আনতে হবে।
শিক্ষক, জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী
sadonsarker2005Ñgmail.com