রোদেলা রহমান : গত এক বছরে একটি ভঙ্গুর অবস্থা থেকে দেশের অর্থনীতি অনেকটা শক্ত ভীতে দাঁড়াচ্ছে। দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন নিয়ে বাগাড়ম্বর না থাকলেও অর্থনীতির অনেক সূচকে এগিয়ে গেছে দেশ। সবকিছু মিলে বিশৃঙ্খলা থেকে সুশৃঙ্খল পরিবেশে ফিরে আসছে দেশের অর্থনীতি।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, হাসিনা সরকারের আমলে অর্থনৈতিক সব সূচককে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে দেখিয়ে আন্তর্জাতিক বাহবা কুড়ানো হলেও, অবকাঠামো খাত ছাড়া দেশের তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নীতি-নৈতিকতা, ন্যায় বিচার সবকিছুতে অধঃপতন হয়েছিল। দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে একটি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। ফলে অর্থনীতিতে কোনো শৃঙ্খলা ছিল না। ২০২৩ সাল থেকেই রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ায় বাজারে ডলার সংকট দেখা দেয়। ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে চরম সমস্যায় পড়েন। অবস্থা এতটাই খারাপ দিকে যায়, বিদেশে পড়ালেখার টিউশন ফি দিতে পারছিল না ছাত্ররা। সে অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের অর্থনীতি।
জানা গেছে, ড. ইউনূসের প্রশাসনের অধীনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যথেষ্ট শক্তিশালী দৃশ্যমান। ২০২৫ সালের জুলাই মাসের শেষে মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৮২৩৬ বিলিয়ন ডলারে, যা মে-জুনের ঊর্ধ্বমুখী দৃষ্টান্ত বজায় রেখেছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেশে প্রেরিত রেমিট্যান্স হয়েছে ২ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বছরে ২৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরের সমাপনী প্রান্তিকে বাংলাদেশের বহির্মুখী হিসাব ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের উদ্বৃত্তে পরিণত হয়েছে, যা আগের তিন বছরের ঘাটতি কাটিয়ে দেশের বৈদেশিক পরিস্থিতিকে সুদৃঢ় করেছে। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও শীতলায়ন সত্ত্বেও দেশের রিজার্ভ মজুত ও বাজারভিত্তিক বিনিময় হার নীতি রাখার ফলে ডলার সংকট এখনও দেখার নয়।
ড. ইউনূসও জানিয়েছেন, ব্যাংকিং সিস্টেম সংস্কার ও ঋঢ ব্যান্ড সম্প্রসারণের মাধ্যমে মুদ্রার স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হয়েছে। যদিও মাঝেমধ্যে নির্বাচনী দাবিতে কয়েকটি সীমিত কর্মসূচি হয়, দেশের মোট রাজনৈতিক পরিবেশ শান্তিপূর্ণ। বড় কোনো সশস্ত্র হইহই বা ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ঘটেনি, যা বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক আস্থা বাড়িয়ে তুলেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৮ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। ভোক্তামূল্য সূচকে (ঈচও) ২০২৫ সালের জুন মাসে পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা মে মাসের ৯ দশমিক ০৫ শতাংশের তুলনায় সামান্য নিম্নগামী।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে স্থিতিশীলতা এসেছে। চাল, ডাল, তেলসহ প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম গত ছয় মাসে তেমন বাড়েনি।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘গত ছয় মাসে কোনো পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ আসেনি। আমদানিতে ডলার সংকট না থাকায় এবং পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় বাজার স্বাভাবিক ছিল।’ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিধিমালা ও জ্বালানি-খাদ্য মজুত নীতি মালার প্রভাব বিবেচনায় এটি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে।
সার্বিকভাবে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বিদেশি মুদ্রা মজুত, রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি, বহির্মুখী উদ্বৃত্ত, রপ্তানি ও মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, এই সাতটি মূল্যসূচকে ইতিবাচক ফলাফল প্রদর্শন করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট থাকায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আত্মবিশ্বাস দিন দিন বেড়েই চলেছে।
সরকারি দুর্নীতি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস
নতুন প্রশাসন দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যা এর নেতৃত্বে দেশব্যাপী সরকারি দপ্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ভূমিকা নিয়েছে।
একই সময় ২০২৫ সালের প্রথমার্ধে দুর্নীতির ৫০টির বেশি উচ্চপর্যায়ের মামলা করেছে বাংলাদেশ দুর্নীতিবিরোধী কমিশন (অঈঈ), যার মধ্যে রয়েছে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রীসহ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির তদন্তনতুনভাবে গঠিত দুর্নীতিবিরোধী সংস্কার কমিশন দেশের সব সরকারি দপ্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নিয়মিত অডিট ও মনিটরিং চালাচ্ছে।
সুশাসনবিষয়ক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মহাসচিব ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ অভিযান যদি ধারাবাহিক থাকে, তবে এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামাজিক আস্থার ক্ষেত্রেও বড় পরিবর্তন আনবে।’
ব্যয় কমানো ও বাজেট দক্ষতা উন্নয়ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ২ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করে, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং কঠোর ব্যয় নিয়ন্ত্রণ নীতির প্রতিফলন। পাশাপাশি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ চার বছর-সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে, যা জনসেবার দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুনর্গঠনমূলক ব্যয় হ্রাস নির্দেশ করে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে শেয়ার বিজকে বলেন, অনুদাননির্ভর প্রকল্প বন্ধ, অব্যবহৃত বাজেট বাতিল এবং বিলাসবহুল ব্যয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।
তবে বাজেট ঘাটতি কমাতে গিয়ে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ কিছুটা কমেছে, যা নিয়ে কিছু বিতর্ক রয়েছে। প্রশাসনের যুক্তি, এই খাতে ব্যয়ের দক্ষতা বাড়ানোই মূল উদ্দেশ্য।
ব্যবসায়ী এম এ মতিন বলেন, ‘বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়া ও ডলার সংকটের ভয়াবহতার দিন শেষ। সরকারের নির্ভরযোগ্য নীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বচ্ছতা এ পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে।’
এদিকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক তাহসিন আরাফাত মনে করেন, ‘রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য ও নতুন বাজারে প্রবেশ বর্তমান প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা। তৈরি পোশাকের বাইরে চামড়া, কৃষিপণ্য এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও প্রবৃদ্ধি চোখে পড়ার মতো।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ বাজার বিশ্লেষণে বলা হয়, বিশ্ববাজারে খাদ্য ও জ্বালানি তেলের দাম স্বাভাবিক থাকায় এবং আমদানি পর্যাপ্ত থাকায় স্থানীয় বাজারে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়নি। যদিও বৈশ্বিক বাজারে মাঝেমধ্যে অস্থিরতা এসেছে, দেশি বাজারে তার তেমন প্রভাব পড়েনি।

Discussion about this post