মো. শাহিন আলম : ভৌগোলিকভাবে ডেনমার্ক, সুইডেন ও নরওয়ে এবং সাংস্কৃতিকভাবে ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড ও ফারো দ্বীপপুঞ্জকে একত্রে বলা হয় স্ক্যান্ডিনেভিয়ান বা নর্ডিক দেশ। মাত্র কয়েক কোটি মানুষের ছোট এই দেশগুলো আজ বিশ্বের বিভিন্ন সূচকে শীর্ষ স্থানে অবস্থান করে। বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপির ২০২৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ডেনমার্ক আইনের শাসন সূচক, নরওয়ে গণতন্ত্র সূচক, ফিনল্যান্ড সুখী ও বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা সূচক এবং আইসল্যান্ড বৈশ্বিক শান্তি ও মানব উন্নয়ন সূচকে শীর্ষ দেশ। এই সাফল্য দেখে প্রশ্ন জাগেÑকীভাবে এত ছোট দেশগুলো এত বড় সাফল্যের মডেল স্থাপন করতে পেরেছে?
প্রথমত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মডেলের মূল ভিত্তি হলো ওয়েলফেয়ার স্টেট বা কল্যাণমুখী রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকার ভাতা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বার্ধক্য ভাতা প্রভৃতি নিশ্চিত করেছে। ডেনমার্কে ৯০ শতাংশ স্কুলশিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্পূর্ণ ফ্রি। ফিনল্যান্ডে হেলিসিংকি স্কুল নেটওয়ার্ক রয়েছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা প্রকল্পভিত্তিক কাজের মাধ্যমে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সৃজনশীল বিষয় শেখে। এতে দেখা যায়, মাত্র ১৪ বছরের শিক্ষার্থীরাও স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধান ও গবেষণায় দক্ষ হয়ে ওঠে। ফলস্বরূপ নাগরিকরা মৌলিক চাহিদা নিয়ে দুশ্চিন্তামুক্ত থেকে উৎপাদনশীল কাজে মনোযোগ দিতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে এখনও দারিদ্র্য, স্বাস্থ্যসেবা ঘাটতি ও শিক্ষাবৈষম্য প্রকট, সেখানে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান কল্যাণনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হতে পারে। সেক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন বস্তি এলাকা কিংবা প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোয় ধীরে ধীরে স্কুল প্রতিষ্ঠা এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রসারে ধাপে ধাপে স্বাস্থ্যকর্মী প্রেরণ করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, প্রগতিশীল করনীতি ও স্বচ্ছ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর শক্ত ভিত্তি। এখানে উচ্চ আয়ের মানুষ বেশি কর দেয় এবং তা নাগরিক কল্যাণে স্বচ্ছভাবে ব্যয় হয়। নরওয়েতে ব্যক্তিগত আয়ের ওপর করের হার সর্বোচ্চ ৩৭ শতাংশ এবং কর উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ জনগণের কল্যাণে ব্যয় হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ এবং বড় অঙ্কের ট্যাক্স ফাঁকি ও কালোটাকার লেনদেন প্রচলিত। কর-নীতি সংস্কার করলে ধাপে ধাপে কর সংগ্রহের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া তৈরি করা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ট্র্যাকিং এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব।
তৃতীয়ত, শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ। ফিনল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। মুখস্থ শিক্ষা নয়, বরং সেখানে সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তা ও গবেষণার ওপর জোর দেয়া হয়। ওইসিডি অনুযায়ী, ফিনল্যান্ডের শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে, যেখানে শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশে স্কুল-কলেজে এখনও গতানুগতিক পরীক্ষামুখী ও কোচিংনির্ভর শিক্ষা প্রাধান্য পায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় দেখা যায়, গবেষণার পরিবর্তে চলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি। যেখানে সুস্থ পরিবেশ নেই, গবেষণার জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ নেই, আবাসন ও খাদ্য সংকটও প্রকট। এই সমস্যাগুলো সমাধানে ধাপে ধাপে টেকসই শিক্ষাক্রম সংস্কার, শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হলগুলোতে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অবসান এবং প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার প্রবর্তন বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন।
চতুর্থত, গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও আইনের শাসন স্ক্যান্ডিনেভিয়ান সমাজের সবচেয়ে শক্ত ভিত্তি। এখানে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান, দুর্নীতির প্রতি জিরো টলারেন্স এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেসি মানুষের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে। বিশ্বব্যাংকের ডেটা অনুযায়ী, ডেনমার্ক ও নরওয়ে দুর্নীতিমুক্তির সূচকে বিশ্বের শীর্ষ দিকে অবস্থান করে। বাংলাদেশে দুর্নীতি, দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতি রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অন্তরায়। তাই ধাপে ধাপে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বায়ত্তশাসিত করা, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ বাড়ানো অত্যন্ত প্রয়োজন।
পঞ্চমত, নারীর ক্ষমতায়ন ও লিঙ্গসমতা। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো সংসদ, প্রশাসন ও ব্যবসায় নারীর সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফসন একটি ৫০/৫০ লিঙ্গসমতা নীতি প্রবর্তন করেছেন, যেখানে সরকারি ও প্রাইভেট খাতের পদে নারী-পুরুষ সমান ভাগ পায়। সুইডেনে সংসদে নারীর অংশগ্রহণ ৪৮ শতাংশ এবং কর্মক্ষেত্রে বেতনবৈষম্য মাত্র ৮ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও এখনও বেতনবৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে হয়রানি ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা বিদ্যমান। লিঙ্গসমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এই দেশগুলোর মডেল আমাদের জন্য পথনির্দেশক হতে পারে।
ষষ্ঠত, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা ও পরিবেশবান্ধব নীতি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ও টেকসই কৃষির মাধ্যমে স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো ভবিষ্যৎ প্রজšে§র জন্য নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তুলছে। ডেনমার্কের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ৫০ শতাংশ সৌর ও বায়ুশক্তি থেকে আসে। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশে ধাপে ধাপে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎস, বন্যা ও ঝড় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও টেকসই কৃষি প্রচলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল ও সম্ভাবনাময় দেশ। তবে দারিদ্র্য, দুর্নীতি, বৈষম্য ও সুশাসনের ঘাটতি উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়ে দেয়, মানবসম্পদে বিনিয়োগ, কর ব্যবস্থার স্বচ্ছতা, প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা সামাজিক সমতা ও পরিবেশবান্ধব নীতি উন্নয়নের সঠিক দিকনির্দেশ। এই দিকনির্দেশনা প্রতিটি নীতি ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যেমন করনীতি সংস্কার, স্বচ্ছ কর সংগ্রহ, স্বাস্থ্যসেবা, সরকারি হাসপাতালের প্রসার, টেকসইভিত্তিক ও প্রকল্পভিত্তিক শিক্ষার প্রবর্তন, নারীর ক্ষমতায়ন, সব ক্ষেত্রে শিক্ষার প্রসার ও কর্মক্ষেত্রে সমতা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ যদি এই শিক্ষাসমূহ বাস্তবায়ন করতে পারে, তবে জনসংখ্যার ভার নয় বরং মানবসম্পদের শক্তি দিয়ে স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর মতো উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুখী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে।
শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post