নুরুন্নাহার চৌধুরী কলি : ‘ইউরোপ যাব’-এই স্বপ্ন এখন অনেক দরিদ্র ও বেকার যুবকের একমাত্র আকাক্সক্ষা। কেউ পরিবার চালানোর আশায়, কেউ ধার-দেনা শোধ করতে, আবার কেউ জীবনের পরিবর্তন আনতে এ আকাক্সক্ষা লালন করেন। কিন্তু এই স্বপ্নের জন্য তারা যে পথ বেছে নিচ্ছেন, সেটি প্রায়ই হয়ে উঠছে মৃত্যুর রাস্তা। ভূমধ্যসাগরের নীল জলরাশিতে ভেসে যায় শত শত জীবন। সাহারার বালির তলে চাপা পড়ে অনেক লাশ। আর কেউ কেউ হারিয়ে যায় চিরতরে।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, গত এক দশকে ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে। তাদের অনেকে বাংলাদেশি, বাকিরা সুদান, ইথিওপিয়া, সিরিয়া, ইরিত্রিয়া, পাকিস্তান, নাইজার, আফগানিস্তানসহ বহু দেশের মানুষ।
এই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসন পদ্ধতি মানুষ মূলত তিনটি কারণে বেছে নেয়। প্রথমত, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানহীনতা। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক সহিংসতা ও যুদ্ধ এবং দালাল ও পাচার চক্রের প্রলোভন।
দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানহীনতা: বাংলাদেশ, সুদান, সিরিয়া ও ইরিত্রিয়ার মতো দেশে বহু তরুণ বেকার রয়েছে। স্থানীয়ভাবে কাজ না থাকায় তারা ইউরোপে জীবনের নতুন সুযোগ খুঁজে বেড়ায়।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও যুদ্ধ: সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান ও ইরিত্রিয়ার মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, গৃহযুদ্ধ ও নিপীড়ন মানুষকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করছে।
দালাল ও পাচার চক্রের প্রলোভন: ভিসাহীন ইউরোপ যাওয়ার রুট দেখিয়ে দালালরা মানুষকে প্রলুব্ধ করে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারও জানে না, প্রিয়জন যাচ্ছে মৃত্যুপথে।
প্রথমে দালালরা বাংলাদেশ থেকে বিমানে যায় দুবাই, ওমান, মিসর বা লিবিয়া। সেখান থেকে দালালদের সহায়তায় প্রবেশ করে সাহারা মরুভূমি হয়ে লিবিয়া বা তিউনিসিয়ায়। লিবিয়া এক প্রস্থ বন্দিদশা ও নির্যাতনের জায়গা, যেখানে পাচারকারীরা মুক্তিপণের জন্য মারধর করে। এরপর অপেক্ষা করে একটি নৌকাÑঅন্ধকার রাতে ভূমধ্যসাগরের দিকে যাত্রা।
দ্বিতীয়ত, জলপথে ত্রিপোলি বা জুয়ারা (লিবিয়া) থেকে সাগরের দিকে ছোট ফাইবার বা কাঠের নৌকায় চাপায়। অনেক সময় একটি নৌকায় ৫০ জনের জায়গায় ২০০-৩০০ জন তুলে দেয়। ইউরোপের তীরে পৌঁছানো আগেই ডুবে যায় নৌকা। সেখানেই শেষ হয় শত স্বপ্নের জীবন।
জাতিসংঘের শরণার্থী-বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তথ্যমতে, ২০১৪ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ৩০ হাজার ৫১০ জনের মৃত্যু বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুধু ২০২৩ সালেই ৩ হাজার ৭৬১ জন মৃত্যু বা নিখোঁজ হয়েছেন।
২০২৩ সালের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর এখন বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত পথ। শুধু লিবিয়া-ইতালি রুটে ২০২৩ সালে দুই হাজার চারশ’র বেশি মানুষ মারা গেছেন।
২০২২ সালে ৬০০ জন বাংলাদেশি অভিবাসীকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করা হয়। একই বছরে প্রায় ১৫০ জন বাংলাদেশি নিখোঁজ বা মৃত।
বাংলাদেশ, সুদান, মিসর, লিবিয়া, তুরস্ক, সিরিয়াÑএসব দেশের ভেতরে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী পাচারচক্র। এরা একেকজনের কাছ থেকে ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত নেয়।
প্রথমে বলে কাজ দেবে ইউরোপে। এরপর নকল ভিসা, ভুয়া কাগজ ও সীমান্ত পারাপারে সহায়তার কথা বলে ফাঁদে ফেলে। যারা যেতে রাজি হয় না, তাদের হুমকি দেয়া হয়।
দালালের খপ্পর থেকে ফিরে এসে এক বাংলাদেশি জানান, লিবিয়ায় আমাদের একটা ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। তিন দিন পানি দেয়নি। মারধর করেছে শুধু টাকার জন্য।
সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ছিল ২০২৩ সালের গ্রিস উপকূলের কাছে। একটি মাছ ধরা ট্রলার ডুবে গিয়ে ৬০০ জনের মৃত্যু হয়, যাদের অধিকাংশ ছিল পাকিস্তান, সিরিয়া ও বাংলাদেশি। নৌকাগুলোয় না থাকে লাইফ জ্যাকেট, না থাকে দিকনির্দেশক যন্ত্র। জেলেরা কিংবা মাফিয়ারা চালায় এই নৌকা। অনেকের লাশ পাওয়া যায় না, তারা সাগরের তলদেশেই হারিয়ে যায়।
প্রশ্ন উঠছেÑএসব ঘটনা কি আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ নয়? জবাব হলো, হ্যাঁ। এই কাজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও অভিবাসন আইনের সম্পূর্ণ বিরোধী। জাতিসংঘের ‘পাচার প্রতিরোধ কনভেনশন, ২০০০’ অনুযায়ী, মানব পাচার একটি অপরাধ। এই কনভেনশন ও তার সংযুক্ত ‘প্যালারমো প্রটোকল’ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি জোরপূর্বক, প্রতারণার মাধ্যমে বা শোষণের উদ্দেশ্যে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাঠানো হয়, তাহলে সেটা অপরাধ।
তবে এই আইন বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। কারণ এই আইন কার্যকর করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। কিন্তু লিবিয়া, সুদান বা সিরিয়ার মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতির কারণে কার্যকর আইন প্রয়োগ খুবই দুর্বল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিনটি প্রধান কারণে এই ভয়ংকর অভিবাসন পথ বন্ধ হয় না। প্রথমত, ইউরোপের কিছু দেশ অভিবাসীদের সস্তা শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করে। ফলে একদিকে যেমন তরুণেরা যেতে চায়, অন্যদিকে কিছু ইউরোপীয় কোম্পানি গোপনে এই মানব পাচারকে উৎসাহ দেয়।
দ্বিতীয়ত, আফ্রিকার ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে পুলিশ ও সীমান্তরক্ষীরা পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত। তারা অর্থের বিনিময়ে চোখ বন্ধ করে দেয়।
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অনিচ্ছা: যদিও মানব পাচার বন্ধে কাগজে-কলমে অনেক চুক্তি আছে, বাস্তবে বড় শক্তিধর দেশগুলো এ নিয়ে তেমন সক্রিয় নয়। অনেক সময় এই সমস্যা তাদের ভোট রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এই বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ২ হাজার ৫৮৯ বাংলাদেশি ইতালির উপকূলে পৌঁছেছেন। গত বছর এই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০৬ জন।
অবৈধ উপায়ে এভাবে ইউরোপযাত্রা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। তারা সতর্ক করে বলেছেন, ঝুঁকি নিয়ে এভাবে মানুষের বিদেশে যাওয়ায় বোঝা যায় দেশে গভীর আর্থ-সামাজিক সমস্যা রয়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, শুধু ফেব্রুয়ারিতেই ১ হাজার ৩৮৩ জন বাংলাদেশি ইতালিতে পৌঁছেছেন। জানুয়ারি মাসে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২০৬। ফেব্রুয়ারিতে সমুদ্রপথে যারা ইতালি গেছেন তাদের মধ্যে ৪২ শতাংশই বাংলাদেশি।
এ বিষয়ে ঢাকা-ভিত্তিক শ্রম অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর বলেন, ‘এটি শুধু অভিবাসনের বিষয় নয়। এটি দেশে বাড়তে থাকা হতাশার প্রতিফলন।’ দেশের অনেক তরুণ বেকার বা স্বল্প বেতনে কর্মরত। তরুণদের মধ্যে যারা বৈধ পথে বিদেশে যেতে পারে না, তারা উন্নত ভবিষ্যতের আশায় এই ঝুঁকিপূর্ণ পথ বেছে নেয়। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই দালালদের খপ্পরে পড়ে, যারা তাদের ইউরোপ নিয়ে মিথ্যা স্বপ্ন দেখায়।’
ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম এবং ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, বিদেশে যাওয়ার প্রতি এক ধরনের মোহ বা ‘মাইগ্রেশন কালচার’ তৈরি হয়েছে। গ্রেপ্তার আর ফেরত পাঠানোর মধ্যে এর আর সমাধান নেই। দেশে শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যতক্ষণ না আমরা তরুণদের দেশে থাকার একটি ভালো কারণ দেখাতে পারছি, ততক্ষণ তারা এমন কিছুর জন্য ঝুঁকি নেবে, যার অস্তিত্বই হয়তো নেই।
স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে, যাতে কেউ জীবন নিয়ে ঝুঁকি না নেয়। গ্রামের মানুষকে বোঝাতে হবেÑইউরোপ যাওয়ার সহজ রাস্তা বলে কিছু নেই। দালালের কথা মানে মৃত্যু ডেকে আনা। প্রতিদিন ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ে হারিয়ে যাচ্ছে অগণিত প্রাণ। তাদের স্বপ্ন ছিল নিরাপদ জীবনের, অথচ তারা মরেছে কাদায়, সাগরে ও নির্জন মরুভূমিতে।
এই মৃত্যুর দায় শুধু দালাল নয়, আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ এবং আন্তর্জাতিক নিষ্ক্রিয়তাও। যদি এখনই ব্যবস্থা না নেয়া হয়, তবে আগামী দিনগুলোয় আমরা আরও অনেক নিখোঁজ সংবাদ শুনতে থাকব। আর ‘ইউরোপ যাব’ এই স্বপ্ন হয়তো একদিন কেবল লাশের গল্পে পরিণত হবে।