সুমাইয়া সিরাজ সিমি : ১৬ ডিসেম্বর মানেই বিজয়— এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রক্ত, ত্যাগ, অপেক্ষা আর অব্যক্ত কান্না। কিন্তু সময় বদলালে শব্দের অর্থও বদলে যায়। একই ১৬ ডিসেম্বর, একই লাল-সবুজ পতাকা, একই জাতীয় সংগীত— তবু অনুভব এক নয়। ২৪-এর জুলাই বিপ্লবের আগের ১৬ ডিসেম্বর আর এখনকার ১৬ ডিসেম্বর— এই দুই সময়ে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ নিজেকেই যেন নতুন করে দেখছে, এক আয়নায়।
জুলাই বিপ্লবের আগের ১৬ ডিসেম্বর ছিল স্মৃতিনির্ভর। বিজয় তখন অতীতের একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে বাঁধা। রাষ্ট্রের নির্ধারিত বয়ান, নির্ধারিত আবেগ আর নির্ধারিত শ্রদ্ধার মধ্যেই দিনটি সীমাবদ্ধ থাকত। মানুষ বিজয় উদ্যাপন করত ঠিকই, কিন্তু সেই উদ্যাপনের সঙ্গে বর্তমান জীবনের সংযোগ ছিল দুর্বল। বিজয় ছিল ইতিহাসের পাতায়, জীবনের বাস্তবতায় নয়।
সে সময় বিজয় দিবস অনেকের কাছেই এক ধরনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্বে পরিণত হয়েছিল। সকালে পতাকা উত্তোলন, শহিদ মিনারে ফুল, টেলিভিশনে একই বক্তৃতা, একই শব্দের পুনরাবৃত্তি। কিন্তু প্রশ্ন করার জায়গা ছিল সংকুচিত। বিজয়ের মান নিয়ে নতুন করে ভাবা কিংবা রাষ্ট্রের কাছে হিসাব চাওয়াকে অনেক সময়ই দেখা হতো অস্বস্তিকর চোখে। ইতিহাস তখন গৌরবের, কিন্তু বর্তমান ছিল অসংলগ্ন।
জুলাই বিপ্লবের আগের ১৬ ডিসেম্বর আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল— বিজয় ও ন্যায় বিচারের মধ্যে দূরত্ব। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হতো, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনে সেই চেতনার বাস্তব প্রতিফলন কমই দেখা যেত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায্য অধিকার, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র- এই শব্দগুলো বিজয়ের আলোচনায় থাকলেও বাস্তবতার মাটিতে সেগুলো অনেক সময়ই অনুপস্থিত ছিল।
এরপর আসে ২৪-এর জুলাই বিপ্লব। এই বিপ্লব শুধু ক্ষমতার বিন্যাস বদলায়নি, বদলে দিয়েছে মানুষের চোখের ভাষা। মানুষ নতুন করে দেখতে শিখেছে- ইতিহাসকে, রাষ্ট্রকে, এমনকি বিজয়কেও। আর সেই পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে ১৬ ডিসেম্বরের অর্থে।
জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী ১৬ ডিসেম্বর আর শুধু স্মৃতির দিন নয়, এটি প্রশ্নের দিন। এখন বিজয় মানে কেবল পরাজিত শত্রুর আত্মসমর্পণ নয়; বিজয় মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস, ভয়ের মুখোমুখি হওয়ার দৃঢ়তা। এখনকার ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস মানুষকে জিজ্ঞেস করতে শেখায়— আমরা কি সত্যিই স্বাধীন? নাকি স্বাধীনতার ভেতরেই নতুন শৃঙ্খলে বাঁধা?
আগে বিজয়কে সম্মান জানাতে প্রশ্ন এড়ানো হতো, এখন প্রশ্ন করাই সম্মানের অংশ হয়ে উঠছে। এই পরিবর্তনের বড় বাহক তরুণ প্রজন্ম। তারা ইতিহাসকে শুধু মুখস্থ করে না, তারা ইতিহাসের সঙ্গে তর্ক করে। তারা এখন শুধু ফুল দিতে আসে না, তারা যুক্তি নিয়ে আসে, তারা ইতিহাসের পাশাপাশি ভবিষ্যতের হিসাব চায়। আজকের তরুণরা জানতে চায়— বিজয় কাদের জন্য? রাষ্ট্র কার কাছে জবাবদিহি? স্বাধীনতার ভেতরে কেন এত অসাম্য? এই প্রশ্নগুলো অস্বস্তিকর, কিন্তু প্রয়োজনীয়। কারণ প্রশ্নহীন বিজয় ধীরে ধীরে আত্মতৃপ্তিতে পরিণত হয়, আর আত্মতৃপ্তি থেকেই জন্ম নেয় নতুন শোষণ।
এই পরিবর্তনের মধ্যেও একটি দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। জুলাই বিপ্লবের পর প্রত্যাশা বেড়েছে বহুগুণ। মানুষ চায় দৃশ্যমান পরিবর্তন, চায় ন্যায়ভিত্তিক শাসন, চায় কথা বলার নিরাপদ পরিবেশ। কিন্তু বাস্তবতা সব সময় প্রত্যাশার সমান গতিতে এগোয় না। ফলে এখনকার ১৬ ডিসেম্বর একদিকে আশার আলো, অন্যদিকে অপূর্ণতার বেদনা— এই দুই অনুভব একসঙ্গে বহন করছে। তবু স্বীকার করতে হয়, এখনকার ১৬ ডিসেম্বর আগের চেয়ে বেশি জীবিত। এটি কেবল অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকা দিন নয়, বরং বর্তমানকে বিশ্লেষণ করার উপলক্ষ। বিজয় এখন আর শুধু ইতিহাসের উত্তরাধিকার নয়, এটি একটি চলমান দায়িত্ব। স্বাধীনতা রক্ষা করার সংগ্রাম যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও কঠিন- এই উপলব্ধি এখন আরও স্পষ্ট।
১৬ ডিসেম্বরের আয়নায় দাঁড়িয়ে আমরা আজ দুই বাংলাদেশকে দেখি। এক বাংলাদেশ, যেখানে বিজয় ছিল স্মৃতির উৎসব; আরেক বাংলাদেশ যেখানে বিজয় হয়ে উঠছে বিবেকের প্রশ্ন। একটিতে ছিল গর্বের পুনরাবৃত্তি, অন্যটিতে রয়েছে দায়িত্বের চাপ। এই দুইয়ের সংঘাতই আমাদের সময়ের বাস্তবতা। এই আয়না আমাদের আত্মসমালোচনার সুযোগ দেয়। আমরা কতটা বদলাতে পেরেছি? কতটা বদলাইনি? রাষ্ট্র কি নাগরিকের কাছে জবাবদিহি করতে শিখেছে? নাগরিক কি নিজের দায়িত্ব বুঝতে শিখেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার মধ্যেই এখনকার ১৬ ডিসেম্বরের আসল তাৎপর্য।
১৬ ডিসেম্বর তাই আর শুধু একটি দিন নয়, এটি একটি মানদণ্ড। এই দিনে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের মাপি— নৈতিকতায়, সাহসে, সত্যে। যদি আমরা প্রশ্ন করতে না পারি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে না পারি, তবে বিজয় কেবল ক্যালেন্ডারের একটি লাল দাগ হয়েই থাকবে।
জুলাই বিপ্লব আমাদের শিখিয়েছে, ইতিহাস স্থির নয়। ইতিহাস বদলায় মানুষের হাতে, মানুষের চেতনার ভেতর দিয়ে। আর সেই বদলের ছাপ পড়ে বিজয়ের অর্থেও। আজকের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের মনে করিয়ে দেয়- স্বাধীনতা কোনো চূড়ান্ত অর্জন নয়, এটি প্রতিদিন নতুন করে অর্জনের লড়াই। এই লড়াইয়ে সফল হওয়া না হওয়াই ঠিক করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কোন আয়নায় নিজেকে দেখবে। একটি আত্মতৃপ্ত রাষ্ট্রের আয়নায়, নাকি একটি সচেতন, প্রশ্নবোধক, মানবিক রাষ্ট্রের আয়নায়। ১৬ ডিসেম্বর সেই আয়নাটিই আমাদের সামনে ধরে রাখে— নিঃশব্দে, কিন্তু গভীরভাবে।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রিন্ট করুন









Discussion about this post