২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভোরে যে সূর্য উদিত হয়েছে, সেটি লাখো জনতার অতি প্রত্যাশিত নতুন দিনের সূর্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হিসেবেই ৮৩৬ জন ছাত্র-জনতার রক্তে যে সূর্য রঞ্জিত, তার মধ্যে রয়েছে অন্তত ১৩৩ শিশু। এসব শিশুর মধ্যে রয়েছে চার থেকে ১২ বছর বয়সী ১১ নিষ্পাপ মাসুম শিশু। এর আগে ৩৬ দিনে দেশ আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যু-উপত্যকা পার হয়ে এসেছে। ১ জুলাই ছাত্ররা যখন সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটার অবসানের দাবি জানিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেটি তখন ছিল সম্পূর্ণ অহিংস। কথিত মাদার অব হিউম্যানিটির গোঁয়ারতুমিতে তা শেষ পর্যন্ত অহিংস থাকেনি। যে তরুণ সহযোদ্ধাদের জীবন বাঁচাতে ‘পানি লাগবে, পানি…’ বলে পানির বোতল বিলাচ্ছিল, তাকে জবাব দেয়া হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে। কর্তৃত্ববাদীর সেবাদাসরা বলেছেন, ‘মুগ্ধ নামে আদৌ কেউ ছিল না।’ যে পুলিশ সদস্য চাকরি বাঁচাতে অন্যায় আদেশ মানতে বাধ্য হয়েছেন, তিনিই সহকর্মীদের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিজের ছেলের প্রাণহীন লাশ দেখে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলেছেন, ‘স্যার, একটি মানুষকে মেরে ফেলতে কয়টি গুলি চালাতে হয়!’ আহত মানুষদের পুড়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা সংঘটিত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক। নিকট অতীতে কে দেখেছে এমন নৃশংসতা! একটি-দুটি নয়, অজস্র দৃষ্টান্ত।
প্রথমে শেখ হাসিনার দম্ভোক্তি ও একগুঁয়েমি এবং পরে নিরীহ ছাত্রদের ওপর তার দল ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সহিংস আক্রমণের কারণে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ শহীদ হলে তা সংবেদনশীল মানুষের হূদয়কে আহত করে। শেখ হাসিনা মোনাফেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মুখে সংলাপের কথা বললেও ছাত্র-জনতার ওপর নিষ্ঠুর আক্রমণ চলতে থাকে। এই চরম নিষ্পেষণের প্রেক্ষাপটে ছাত্রদের সঙ্গে দেশজুড়ে যোগ দিতে শুরু করে সাধারণ জনতা-কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, শিক্ষক, আইনজীবী, অভিভাবক, নারী সমাজ, শিল্পী, শ্রমিক ও পেশাজীবীরা। এই জনতার কাঁধে কাঁধ মেলায় আওয়ামী বা বিএনপি-অনুরাগী এবং বাম-ডান সবাই। অভূতপূর্ব গণজাগরণ ভাসিয়ে নিয়ে যায় দেশকে। নিজেকে রক্ষায় ৩৬ দিনের পরম স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর শেখ হাসিনা নির্বাচনব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে তার একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। বিরোধী দল ও কণ্ঠকে নিষ্ঠুরভাবে স্তব্ধ করে দেয়া হয়, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যুব্জ করা হয় এবং অবরুদ্ধ করা হয় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। কিন্তু দালাল গণমাধ্যমের কাছে নমস্য হয়ে ছিলেন। দুর্নীতি, স্বজন-তোষণ, ব্যাংক লুট আর বিপুল অর্থ পাচারে দেশের অর্থনীতি পর্যুদস্ত করার পর থামতে বাধ্য হয়েছেন হাসিনা। ন্যূনতম সংস্কার শেষে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বচনের মাধ্যমে আধুনিক সভ্য গণতান্ত্রিক সমাজে প্রবেশ করুক দেশ। সব সময় জয় হোক সত্য, ন্যায় আর মানবতার। এ পর্যায়ে আসতে যাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা রয়েছে, জাতি কখনও তা বিস্মৃত হবে না।

Discussion about this post