শেয়ার বিজ ডেস্ক : যখনই স্বাস্থ্য খাতের কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতি ও লুটপাটের অভিযোগ ওঠে, তখনই ঘুরেফিরে স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর নাম সামনে আসে। বিগত আওয়ামী সরকারের সময়ে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারের মধ্যদিয়ে স্বাস্থ্য খাতে ‘লুটপাটের দানবে’ পরিণত হন সদ্য গ্রেপ্তার হওয়া মিঠু।
অভিযোগ উঠেছে, মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু এবং তার সিন্ডিকেটের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বরাদ্দ পেতো দেশের হাসপাতালগুলো। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা হাসপাতালের জন্য অপ্রয়োজনীয় মেশিন সরবরাহ করে সেগুলোর বাজারমূল্যের চেয়ে আট থেকে ১০ গুণ বেশি দাম নির্ধারণ করতো। এরপর তারা মন্ত্রণালয় থেকে সেই বরাদ্দের তালিকা তৈরি করে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কয়েক বছরে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে মিঠুর স্ত্রীর প্রতিষ্ঠান ফিউচার ট্রেড ৮৬ কোটি টাকার বেশি কাজের আদেশ পায়। এরমধ্যে প্রায় ৫৬ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়। ওই সময়ে মিঠু মুগদা হাসপাতালকে একটি মেডিকেল ল্যাবরেটরি- ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার ডিপ ফ্রিজার প্রায় ৭০ লাখ টাকায় কিনতে বাধ্য করেছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দল প্রমাণ পেয়েছে যে, সেই ফ্রিজারটি এখনও অকেজো ও অব্যবহƒত অবস্থায় পড়ে আছে।
আরেকটি উদাহরণ- দিনাজপুরের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সেখানকার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বেবি স্কেলার (বাচ্চাদের ওজন মাপার যন্ত্র) সরবরাহ করেছিল, যার দাম ছিল সাড়ে সাত হাজার টাকা। যন্ত্রটি কিছুদিন ব্যবহারের পর নষ্ট হয়ে গেলে মিঠু সিন্ডিকেট সেটি মেরামতের জন্য ব্যয় দেখায় চার লাখ ১১ হাজার ৯০০ টাকা। এই পরিমাণ টাকা দিয়ে প্রকৃতপক্ষে আরও ৫৪টি নতুন যন্ত্র কেনা যেত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে মিঠুর প্রায় ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে। যার মধ্যে কাগজে-কলমে প্রায় ৭৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মামলা হয়েছে। তবে দুদকের ধারণা, বাস্তবে মিঠুর মালিকানায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। যেহেতু দুদক দালিলিক মূল্য বিবেচনা করে, তাই হিসাব করা সম্পদের মূল্য অনেক কম দেখাচ্ছে। এছাড়া মামলায় তার সব সম্পদের হিসাব আনা হয়নি; বাকি সম্পদগুলো চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানা গেছে। দুদকের কাছে আরও তথ্য আছে যে তিনি আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন।
আলোচিত মিঠুর মূল প্রতিষ্ঠানের নাম লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ। এর বাইরে তার নামে-বেনামে রয়েছে আরও ৬০টি প্রতিষ্ঠান। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে মিঠু জিম্মি করে রেখেছে দেশের স্বাস্থ্য খাত। গত ১৫ বছর মিঠুর বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা আদৌতে নেয়া হয়নি। বরং এমনও অভিযোগ রয়েছে দুদকের নিয়ন্ত্রণও মিঠুর হাতে ছিল।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ ীয় ঔষধাগার, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও আইএইচটি সিলেটসহ ১২ হাসপাতালে সিন্ডিকেট তৈরি করে অনিয়ম ও দুর্নীতি করে গেছেন মিঠু। ইতোমধ্যে যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও কোটি কোটি টাকা উত্তোলনের প্রমাণও মিলেছে। সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতিতে ইউরোপ-আমেরিকার নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল স্টিকার লাগিয়ে অথবা নতুন যন্ত্রের বদলে পুরোনো বা রিকন্ডিশন্ড যন্ত্র সরবরাহের অনেক ঘটনা ঘটেছে। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সবকিছুকেই আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, মিঠুর বিরুদ্ধে অনিয়মগুলোর ধরনগুলো হলো সিন্ডিকেট করে অতি উচ্চমূল্য দেখিয়ে নিম্নমানের মালামাল সরবরাহ, দরপত্রের শর্তানুযায়ী মালামাল সরবরাহ না করা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে মালামাল সরবরাহ না করেই বিল উত্তোলন, অপ্রয়োজনীয় এবং অযাচিত মালামাল সরবরাহ করা ইত্যাদি।
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন বলেন, অবৈধ সম্পদের মামলায় মিঠু গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছে। এখন তদন্ত কর্মকর্তা আইন অনুসারে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদসহ প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেবেন। যতটুকু জানি দেশের বাইরেও তার সম্পদ রয়েছে। সবকিছু তদন্তের আওতায় আনা হবে।
দুদকের খাতায় আলোচিত মিঠুর প্রায় ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসাব পাওয়া গেছে। যার মধ্যে কাগজে-কলমে প্রায় ৭৬ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ। কিন্তু বাস্তবে মিঠুর মালিকানায় হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে মনে করছে দুদক।
তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে রাজধানীর বনানী ডিওএইচএস এলাকার রোড-৪/এ-তে ৫ কাঠা জমিতে পাঁচতলা বাড়ি, বনানীর ৬নং রোডের ব্লক সি-তে ১৮২৫ বর্গফুট ফ্ল্যাট, উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১০নং রোডে ৫.২৫ কাঠা জমিতে চারতলা বাড়ি, একই এলাকার ৫ নম্বর সেক্টরের ৭নং রোডে ছয়তলা বাড়ি, গুলশানের সুবাস্তু নজর ভিলায় ৩৭২৫ ও ৫৮৫ বর্গফুটের ফ্ল্যাট ও দুটি কার পার্কিং, দক্ষিণ কল্যাণপুরের ১ নম্বরে রোডে ১৫৮৩ বর্গফুটের ফ্ল্যাট, উত্তরার ১৫-সি রোডের তিন কাঠার দুটি প্লট ও টঙ্গী শিল্প এলাকায় বিঘা ১৮ কাঠা জমি ও ভবন। ঢাকার বাইরে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ, ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ২০ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ১৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ, চার দশমিক ৮৭ শতাংশ তিন দশমিক ৩৩ শতাংশ, ছয় শতাংশ, ছয় দশমিক ১৬ শতাংশ, ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ ও ৪৭ দশমিক ৬৬ শতাংশের ১০টি প্লট তার মালিকানা রয়েছে। অন্যদিকে একই জেলার মাসিমপুর মৌজায় ৪৩ দশমিক ৬০ শতাংশ, রংপুরের কোবারু এলাকায় আট শতাংশ, চব্বিশ হাজারিতে ৭৫ শতাংশ, কোবারুতে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ, বুড়িরহাটে তিন শতাংশ, বিনোদপুরে ৩১ দশমিক ৫০ শতাংশ, ৬২ শতাংশ, ৩৬ শতাংশ, ৩৬ শতাংশ, ১৯ শতাংশ ও ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, রংপুরের দেওডোবায় নয় শতাংশ ও ১৩৯ শতাংশ জমি এবং রংপুরের বুড়িহাট রোডে কয়েক কোটি টাকায় তৈরি একটি বাড়ি রয়েছে।
এছাড়া একোয়া কালচার ফার্মস লিমিটেড, জিএমজি এয়ারলাইন্স, নর্থ চিকস প্রাইভেট লিমিটেড, ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল, কফিল উদ্দিন মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, বায়ো মেডিকেল মার্চেন্টাইজ প্রাইভেট লিমিটেড ও আই-পাইওনিয়ার হিটাসি প্রাইভেট মেডিকেলে শত কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে।
অন্যদিকে শেয়ার বাজারে শত কোটি টাকার বিনিয়োগ, ব্যক্তিগত দুটি গাড়ি, সাউথইস্টসহ বিভিন্ন ব্যাংকে শতকোটি টাকার সম্পদ থাকার তথ্য দুদকের কাছে রয়েছে।
মিঠুর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের মামলা : দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে দুদকের উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে মিঠুকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
মামলার এজাহারে জানা যায়, লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইস ও টেকনোক্রেট নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক আলোচিত মিঠু। যেখান বলা হয়েছে- কৃষিজমি ক্রয়, জমি লিজ, প্লট, ফ্ল্যাট ও বাড়ি নির্মাণে মোট ১৮ কোটি ৪০ লাখ ৫১ হাজার টাকার স্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানিতে শেয়ার ও বিনিয়োগ, গাড়ি ক্রয়, ব্যাংক হিসাবের স্থিতি, স্বর্ণালংকার, আসবাবপত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী মিলিয়ে আরও ৫৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ তার নামে পাওয়া গেছে।
স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে তার সম্পদের মোট মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এছাড়া মিঠুর নামে পারিবারিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। অর্থাৎ সম্পদ ও ব্যয়সহ তার মোট সম্পদের হিসাব দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অন্যদিকে অনুসন্ধানে বৈধ উৎস পাওয়া গেছে ৭১ কোটি ৪৯ লাখ টাকার। অর্থাৎ বৈধ আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে ৭৫ কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণ মিলেছে। ২০১৬ সালে প্রকাশিত বহুল আলোচিত পানামা পেপারসে নাম আসে মিঠুর।
পরে তার বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় মামলা হয়। ২০২০ সালে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়। ওই সময়ে দুদক উপপরিচালক মো. মশিউর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল অনুসন্ধানের দায়িত্ব পায়। ওই বছরের ৬ আগস্ট মাস্ক-পিপিই ক্রয় দুর্নীতির অনুসন্ধানে মিঠুকে তলব করা হলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে হাজির হননি তিনি। ২০২৩ সালের ১৮ অক্টোবর তার বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। ওই বছরই আদালতের নির্দেশনায় তার স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে মিঠুকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।