নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প খাতকে একটি সুসংগঠিত, রপ্তানিমুখী ও টেকসই শিল্পে রূপান্তর করতে হলে অর্থায়নের সীমাবদ্ধতা, দক্ষ জনবল সংকট, কাঁচামালের খরচ বৃদ্ধি, উৎপাদন অবকাঠামোর ঘাটতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে ব্র্যান্ডিং দুর্বলতার মতো দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পিকেএসএফ ভবন-১-এ ‘বাংলাদেশের হস্তশিল্পের বিকাশে করণীয়’ শীর্ষক এক কর্মশালায় বক্তারা এ কথা বলেন। হস্তশিল্প শিল্পের উন্নয়ন, রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ এবং বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্য নিয়ে পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এ কর্মশালার আয়োজন করে।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা বলেন, শতকোটি টাকার দেশীয় বাজার ও বিলিয়ন ডলারের বৈশ্বিক বাজার থাকা সত্ত্বেও সরকারি-বেসরকারি পরিকল্পনা, গবেষণা, ডিজাইন উন্নয়ন এবং নীতিগত সহায়তা ছাড়া হস্তশিল্প খাতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
এর জন্য এ খাতে সহজ শর্তে অর্থায়ন জরুরি বলে মনে করছেন পিকেএসএফের কর্মশালার বক্তারা। তারা বলছেন, হস্তশিল্প খাতে সহজ শর্তে অর্থায়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং রপ্তানি সহজীকরণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন যেমন বাড়বে, তেমনি নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে এই হস্তশিল্প খাত।
এজন্য এ খাতের পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ, ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস, নকশা কেন্দ্র স্থাপন, প্রশিক্ষণ ও রপ্তানি প্রচারণা জোরদারের সুপারিশ করেন কর্মশালার অংশগ্রহণকারীরা।
অনুষ্ঠানে পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের সভাপতিত্ব করেন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন পিকেএসএফের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. আকন্দ মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। এসময় পিকেএসএফ’র বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
হস্তশিল্প শিল্পের বর্তমান অবস্থা, বাজার সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ ও উন্নয়ন কৌশল বিষয়ে বিস্তারিত উপস্থাপনা প্রদান করেন পিকেএসএফের উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. হাবিবুর রহমান।
উপস্থাপনায় বলা হয়, হস্তশিল্প বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ও দ্রুত সম্ভাবনাময় খাত। দেশে বর্তমানে প্রায় ১ লাখ ৪৮ হাজার কারিগর রয়েছে, এদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ নারী, যারা প্রত্যক্ষভাবে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। উৎপাদনের ৯৫ দশমিক ৮ শতাংশই সম্পূর্ণ গৃহভিত্তিক, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
পিকেএসএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল কাদের বলেন, ‘হস্তশিল্প খাতে সহজ শর্তে অর্থায়ন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং রপ্তানি সহজীকরণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এ খাত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।’
এজন্য তিনি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদারত্বে এ খাতকে আরও সংগঠিত, টেকসই ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিল্পে রূপান্তর করার কাজে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
কর্মশালায় জানানো হয়, বাংলাদেশে হস্তশিল্পের স্থানীয় বাজারের বার্ষিক আকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০২৪ সালে বৈশ্বিক হস্তশিল্পের বাজার ছিলো ১ লাখ ১০ হাজার ৭৬৭ কোটি ইউএস ডলার। তবে বিশাল এ বাজারে বাংলাদেশের অংশীদারিত্ব এক শতাংশেরও কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ২ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যের হস্তশিল্প রপ্তানি করেছে।
কর্মশালায় বক্তারা জানান, বৈশ্বিক বাজার প্রতিবছর প্রায় ২০ শতাংশ হারে সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং ২০৩২ সালের মধ্যে বাজারের আকার ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বক্তারা বলেন, নকশিকাঁথা, মাটির তৈরি পণ্য, বাঁশ-বেত, জামদানি, পাটজাত পণ্য, টেরাকোটাসহ দেশীয় হস্তশিল্প পণ্যের প্রধান ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো।
দেশীয় কাঁচামাল দিয়ে উৎপাদিত এসব পণ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মূল্য সংযোজন সম্ভব হয় বলেও কর্মশালায় জানানো হয়।
বক্তারা এ খাতের উন্নয়নের জন্য সাপ্লাই চেইন শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন। তারা মনে করেন, কারুশিল্প গ্রাম উন্নয়ন, অর্থায়নের সুযোগ বৃদ্ধি, হস্তশিল্প-সম্পর্কিত কারিগর ও কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, হস্তশিল্প ম্যাপিং, ভর্তুকি/প্রণোদনা, হস্তশিল্পের রপ্তানি উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মান ও সার্টিফিকেশন জোরদার খুবই জরুরি।
এছাড়া পিকেএসএফের কর্মশালায় ডিজিটাল মার্কেটপ্লেস ও ই-কমার্স উন্নয়নের মাধ্যমে হস্তশিল্প খাতের পণ্যের বিপণনকে কার্যকর করা সম্ভব বলে মত দেন। তারা এ ধরনের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে এ খাতের উদ্যোক্তাদের যুক্ত হওয়ার পরামর্শ প্রদান করেন।
দেশে দীর্ঘদিন ধরেই হস্তশিল্প খাতকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এখনও কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌছাতে পারেনি এই খাতটি। এর জন্য বিভিন্ন সময় এখাতকে নিয়ে বিভিন্ন মেলা উদ্যাপনসহ নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বিগত সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও হস্তশিল্প খাতকে অত্যাধিক গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এ খাতে বড় ধরনের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন পিকেএসএফের কর্মশালার উদ্যোক্তারা।
প্রিন্ট করুন











Discussion about this post