আগামী পাঁচ থেকে সাত বছরে এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানির সম্ভাবনা আছে। শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ‘রোড টু মেড ইন বাংলাদেশ অ্যান্ড এগ্রো মেশিনারি ফেয়ার’-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধে এমনই বলা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির শিল্প উপদেষ্টা বলেছেন, জাতীয় শিল্পনীতিতে অটোমোবাইলস, কৃষি যন্ত্রাংশ ও হালকা প্রকৌশল—এই তিনটি খাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এ খাতগুলো উৎপাদনশীল শিল্পের বিকাশ, রপ্তানির বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষিযন্ত্র আমদানি, খুচরা যন্ত্রাংশ, রক্ষণাবেক্ষণসহ পূর্ণাঙ্গ সরবরাহ ব্যবস্থার চাহিদা তৈরি হবে। বর্তমানে দেশের কৃষিযন্ত্রের মাত্র ২০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়, বাকি ৮০ শতাংশ আমদানিনির্ভর। অথচ বেশ কয়েকটি কৃষিযন্ত্র তৈরির সক্ষমতা আমাদের আছে। নীতিসহায়তা, অর্থায়ন, দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা গেলে এই ২০ শতাংশ বাড়িয়ে অচিরেই ৫০ শতাংশে নেয়া সম্ভব।
টয়োটা ও হোন্ডার মতো বিশ্বমানের কোম্পানিগুলো এখন গাড়ি নির্মাণে অধিকাংশ যন্ত্রাংশ আউটসোর্সিং করছে। পণ্যে ‘মেইড ইন জাপান’ কিংবা ‘মেইড ইন জার্মানি’ লেখা হলেও তারা বিদেশ থেকে ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ আমদানি করে অ্যাসেম্বল করেন। অটোমোবাইল, বিমান, ইলেকট্রনিকসসহ বিভিন্ন পণ্যের বিশ্বখ্যাত সব নির্মাতারাও তা-ই করছেন। এসব যন্ত্রাংশের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর ওপর নির্ভর করছে। কিন্তু আমাদের দেশে হালকা প্রকৌশল খাতের দীর্ঘ ইতিহাস ও সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববাজারে আউটসোর্সিংয়ে নিজেকে তুলে ধরতে পারেনি।
অনেকেই বলেন, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং (এলই) বা হালকা প্রকৌশল খাত হলো সব শিল্পের শেকড়। কারণ ওই এলই ওয়ার্কশপগুলোই প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী সব ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশ তৈরি করে শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখে। অথচ দৃশ্যমান কোনো সাফল্য, পণ্যের মান নিয়ে প্রশ্ন ও রপ্তানি না থাকায়; সম্ভাবনা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ছে শিল্পটি। আমাদের এলই ওয়ার্কশপগুলোয় একসময় বাস কিংবা ট্রাক নয়, ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী যে কোনো ব্র্যান্ড বা মডেলের গাড়ির যে কোনো পার্টস বানানো হতো। সময়ের সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির আপডেট ও চীনা পণ্যের আগ্রাসনে অনেকেই এ ব্যবসা সংকুচিত করে ফেলেছেন। এছাড়া দেশে নির্মিত যন্ত্রাংশের ‘মান ভালো না’—এমন কথা প্রচলিত থাকায় ক্রেতাদের কাছে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে।
দেশে আশির দশকের গোড়ার দিকে স্বাধীনতা-পরবর্তী শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (এলই) যাত্রা শুরু হয়। ব্যাপক চাহিদা তৈরি হওয়ায় রাতারাতি এলই পণ্যের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। রাজধানীর ধোলাইখাল এবং জিনজিরা হয়ে ওঠে এ খাতের তীর্থস্থান। এসব পণ্যের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দেশের শিল্প বিপ্লবের দ্বার খুলে দেয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, যশোর এবং খুলনায় এসব শিল্প গড়ে ওঠে।
বিভিন্ন যন্ত্রাংশ উৎপাদনে করতে প্রয়োজনীয় উপকরণের সঠিক মাত্রা ও উপাদান মানের ভিন্নতা থাকায় তা টেকসই হচ্ছে না। কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে বহু ধাপ পেরিয়ে যন্ত্রাংশ বড় উৎপাদনে যায়। এখানে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এসব কাটিয়ে ওঠা গেলে হালকা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি রপ্তানির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে। এলই খাতের পণ্য রপ্তানি থেকে আরও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে এ খাতের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়া উচিত।

Discussion about this post