শেখ শাফায়াত হোসেন : ই-লানিং অ্যান্ড আর্নিং লিমিটেডের ব্যাংক লেনদেন বন্ধ রাখতে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেই অনুযায়ী, ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের সব ব্যাংক হিসাব বন্ধ থাকার কথা। তবে দুদক ও বিএফআইইউ’র চোখ ফাঁকি দিয়ে এই প্রকল্পের লেনদেন করে যাচ্ছে ই-লানিং অ্যান্ড আর্নিং।
বিএফআইইউর নির্দেশনা উপেক্ষা করে ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের ব্যাংক হিসাব চালু রেখেছে আইএফআইসি ব্যাংক। জানা গেছে, গত ৩০ জুনভিত্তিক ও ৩০ সেপ্টেম্বরভিত্তিক ই-লার্নিং ও আর্নিংয়ের ২৪ কোটি টাকা করে দুটি বিল দিয়েছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ফলে মোট ৪৮ কোটি টাকার এই বিল ভাঙাতে আইএফআইসি ব্যাংকে জমা দেয় ই-লার্নিং। কৌশলে সেই টাকা ব্যাংকের হিসাব থেকে তুলতে পারছে ই-লার্নিং।
অথচ গত জুনে দুদক থেকে ই-লার্নিংয়ের সব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ রাখতে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে সেই নির্দেশনা কৌশলে উপেক্ষা করে লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছে ই-লার্নিং।
অভিযোগ রয়েছে, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার সাবেক এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঘুষ দিয়ে ৩০০ কোটি টাকার কাজ নেয় ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লি.। অথচ ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ আলম জুলাই আন্দোলনে ছাত্র হত্যা ও উসকানি দেয়ার অভিযোগে ৭০টির মতো মামলা হয়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণহত্যা মামলাও রয়েছে মাসুদ আলমের বিরুদ্ধে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মাসুদ আলমের প্রতিষ্ঠানকে ২৯৭ কোটি টাকার ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্পের কাজ দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে জুলাই আন্দোলনে মাসুদের ভূমিকা ছিল নেতিবাচক। এ কারণে তার নামে গণহত্যা মামলাও হয়। কিন্তু এসব কিছু উপেক্ষা করে গত বছরের শেষ দিকে ই-লার্নিংকে কাজটি দেয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার তৎকালিন এপিএস মোয়াজ্জেম হোসেন এই প্রকল্পের কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য ই-লার্নিংয়ের মাসুদ আলমের কাছ থেকে ১০ কোটি টাকা ঘুষ নেন। এছাড়া ওই দপ্তরের আরও কয়েকজনকে ঘুষ দেয়া হয়। ঘুষ দেয়া হয় প্রায় ২০ কোটি টাকা। যুব উন্নয়ন অধিপ্তরের ওই প্রকল্পের পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ খানের বিরুদ্ধেও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
মাসুদ আলমের মতো আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের কাজ দেয়ায় খাতসংশ্লিষ্টদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দেয়।
জানা গেছে, মাসুদ আলম একসময় ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে নাম অন্তর্ভুক্ত থাকায় ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি পায়। এই পরিচিতি কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু আইটি খাতের প্রতিষ্ঠান খুলে বসেন মাসুদ আলম। এর মধ্যে নগদহাট বাংলাদেশ লিমিটেডের মাল্টি-লেভেল মার্কেটিং ধাঁচের ব্যবসার মাধ্যমে দিয়ে বিপুল টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম বদলে প্রমিস মার্ট করা হয়। প্রমিস গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানের টাকায় প্রমিস অ্যাসেটসহ মোট ১৫টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন মাসুদ।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মাসুদ আলম কিছুটা আড়ালে থেকে প্রমিস গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গত এক বছরে তাকে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা যায়নি। এদিকে মাসুদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আওয়ামী ঘনিষ্ঠদের প্রতিষ্ঠান যাতে আর না বলা হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন প্রমিস মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইস্রাফিল মোল্লা। তিনি বিভিন্ন জায়গায় জামাতঘনিষ্ঠ বলে নিজেকে প্রচার করছেন। বিএনপিপন্থি সাংবাদিক কাদের গনী চৌধুরীর সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করছেন। গত ২৬ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদারের সঙ্গে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে দেখা করতে যায় প্রমিস মার্টের এমডি ইস্রাফিল মোল্লাসহ একটি প্রতিনিধিদল।
তবে এভাবে ইমেজ ক্লিন করলেও অতীতের অপকর্ম থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
২০২৪ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগের ব্যানারে শরিয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেন মাসুদ আলম।
নির্বাচনী হলফনামার সঙ্গে প্রদত্ত আয়কর নথি অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মাসুদ আলমের নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৭৯ টাকা। ২০২৩-২৪ করবর্ষে মাসুদ আলমের আয় ছিল ২১ লাখ ৩ হাজার টাকা।
হলফনামায় স্থাবর সম্পদের তথ্যের বিবরণ দিতে গিয়ে মাসুদ উল্লেখ করেন, তার নিজ নামে ছয়টি বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। অর্জনকালে ওই সম্পদের মূল্য ছিল ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, হলফনামা ও আয়কর নথিতে উল্লিখিত তথ্যের বাইরেও বিপুল পরিমাণ সম্পদ রয়েছে মাসুদ আলমের। এ নিয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক। ইতোমধ্যে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। একইসঙ্গে স্ত্রীসহ মাসুদ আলমের পালিয়ে যাওয়ার শঙ্কা থাকায় বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছে।
ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং লি. বেসিস ও বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সদস্য। এই দুটি সংগঠনে মাসুদ আলমের যোগাযোগের জন্য দুটি আলাদা মোবাইল নম্বর দেয়া রয়েছে। অথচ দুটি নম্বরই বন্ধ পাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাসুদ আলম আগের কোনো মোবাইল ফোন নম্বর ব্যবহার করছেন না। ফলে তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। প্রমিস মার্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইস্রাফিল মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে তাৎক্ষণিক মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মনসুর মোস্তফার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি কোনো জবাব দেননি।
এদিকে ই-লার্নিং অ্যান্ড আর্নিংয়ের ব্যাংক হিসাব বন্ধ রাখার নির্দেশনা থাকলেও এরই মধ্যে ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ৪০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে মাসুদ আলমের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানকে।
