শেখ শাফায়াত হোসেন : ইসলামী ব্যাংকে অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এএমডি) কামাল উদ্দীন জসীমের নিয়োগের মেমো (স্মারক) হুট করে পর্ষদ সভায় আনতে বলেন চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম জোবায়দুর রহমান। পরিচালকদের কাছে তাকে ‘ফিট’ মনে হওয়ায় কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই নিয়োগ পেয়ে যান তিনি।
অথচ ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্বে থাকা ওমর ফারুক খানকে এই নিয়োগের বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানানো হয়নি। হুট করে চেয়ারম্যান এমডিকে বলে বসেন, ‘এএমডি নিয়োগের মেমোটা (স্মারক) আনেন।’
‘এ ধরনের কোনো মেমো পর্ষদে উপস্থাপন করা হচ্ছে না’Ñ এমন তথ্য এমডি জানালে চেয়ারম্যান বলেন, ‘৭৩৮ নম্বর মেমোটা দেখুন।’
ঘটনাটি চলতি বছরের ৩১ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের ৩৭২তম পর্ষদ সভার। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ একটি সূত্র সভার এই বিবরণ দিয়েছেন। সূত্র জানায়, হুট করে আলোচনা ওঠায় পর্ষদের সদস্যরা এএমডি নিয়োগের বিষয়ে পর্যালোচনা করার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। ফলে দ্রুত সময়ের মধ্যে এএমডি নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসলামী ব্যাংকের একজন পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, কামাল উদ্দীন জসীমকে ফিট (যোগ্য) মনে হয়েছে। এ কারণে তাকে এএমডি নিয়োগ দেয়ার সবাই সম্মতি জানিয়েছেন।
একজন মাত্র প্রার্থীর মধ্যে থেকে এএমডি নিয়োগে আপত্তি না থাকার বিষয়ে ওই পরিচালক বলেন, বাইরের ব্যাংক থেকে অন্য কাউকে এএমডি নিয়োগ দেয়া হলে তার পক্ষে কাজ বুঝতে অনেক সময় লাগে। সেই দিক থেকে নিজেদের ব্যাংক থেকে নিয়োগ দেয়াই ভালো বলে মনে হয়।
তবে এই নিয়োগের বিষয়ে এমডিকে অন্ধকারে রাখার সমালোচনা করেন অন্য পরিচালকরা। তারা বলছেন, মেমো প্রস্তুত করে বোর্ডে উত্থাপন করার দায়িত্ব ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। তিনি জানতেন না এই মেমোর কথা। তাছাড়া কামাল উদ্দীন জসীম উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হয়েছেন এক বছরও হয়নি। জ্যেষ্ঠতার দিক থেকে অন্তত তিনজন ডিএমডিকে টপকে তাকে এএমডি করা হয়।
তারা আরও বলছেন, ইসলামী ব্যাংকে আগের দখলদারদের অনিয়ম ঢাকতে, দখলদারদের সহযোগী কর্মীদের ব্যাংকে বহাল রাখতে ষড়যন্ত্র চলছে। ব্যাংকটির এমডির বিরুদ্ধেও কাদা ছোড়াছুড়ি শুরু হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, চেয়ারম্যানের আশীর্বাদ পাওয়ায় এমডির নির্দেশনাও মানেন না এএমডি কামাল উদ্দীন জসীম। আর এভাবে এমডির নির্দেশনা উপেক্ষা করার জন্য চেয়ারম্যান কৌশলে মানবসম্পদ বিভাগের দায়িত্ব দিয়েছেন জসীমকে। ফলে কোনো কর্মী অন্যায় করলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না এমডি ওমর ফারুক খান। এ ক্ষেত্রে এমডি যখন এএমডিকে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দেন, তখন এএমডি তা অমান্য করেন। ফলে এ নিয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।
অতীতে লুটপাটকারীদের ব্যাংকে প্রশ্রয় না দেয়ার বিষয়ে এমডি ওমর ফারুক খানের নির্দেশনাও মানেন না এএমডি কামাল উদ্দীন জসীম। বরং উল্টো অনিয়মকারীদের পক্ষে অবস্থান নেন জসীম। এই কাজটি সহজ করে দিতে এএমডির জন্য ‘স্পেশাল ইনভেস্ট উইন্ডো (এসআইডব্লিউ) ২’ নামে বিশেষ একটি উইন্ডো খোলা হয়েছে।
ওই উইন্ডোর আওতায় ইতোমধ্যে বিতর্কিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী নাবিল গ্রুপকে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়া শুরু হয়েছে। এই গ্রুপকে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে এমডি ও এএমডির মধ্যে যুক্তিতর্ক হচ্ছে বলেও জানা গেছে। নাবিল গ্রুপ সরাসরি কোনো অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয়Ñ এমন যুক্তি দিয়ে ওই উইন্ডো থেকে আবারও বিনিয়োগ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে প্রস্তাব তোলা হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকটির এক পরিচালক শেয়ার বিজকে বলেন, নামে-বেনামে ঋণ বের করা কোম্পানিগুলোর কোনো কোনোটির লোকজন ওই গ্রুপের সঙ্গেই জড়িত ছিলেন। এমনকি ওইসব ঋণের উপকারভোগী হয়েছে গ্রুপটি। এসব তথ্য নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।
এরপরও সম্প্র্রতি অনুষ্ঠিত এক পর্ষদ সভায় এই গ্রুপকে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে আরও আলোচনা হয়েছে বলে জানান ওই পরিচালক।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসলামী ব্যাংকে ২ লাখ কোটি টাকার বেশি লুটপাট করে কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। এতে সরকারের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সরকার পতনের পর ব্যাংকটি সংস্কারের অংশ হিসেবে পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পুনর্গঠিত পর্ষদের চেয়ারম্যান করা হয় সোনালী ও রূপালী ব্যাংকের সাবেক এমডি মো. ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদকে। অভিযোগ আছে, লুটপাটকারীদের ধরার পরিবর্তে তাদের টাকার কাছে ধরাশায়ী হন তিনি। এক বছরের মাথায় তাকে পদত্যাগ করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাকে নিয়ে তদন্ত করছে। সম্প্র্রতি তাকে গ্রেপ্তারও করা হয়।
এ রকম একটি পরিস্থিতিতে মাসুদের পদত্যাগের পরে ব্যাংকটির স্বতন্ত্র পরিচালক জোবায়দুর রহমানকে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান করা হয় গত জুলাই মাসে। চেয়ারম্যান হয়েই ব্যাংকটিতে নিজস্ব বলয় তৈরি করতে চেষ্টা করেন তিনি। ইসলামী ব্যাংকের পর্ষদে আরও দুজন পরিচালককে নিয়ে এই বলয় তৈরি করেছেন তিনি। ফলে ওই দুই পরিচালকের সমর্থন পাওয়ায় পর্ষদে যেকোনো সিদ্ধান্ত অনুমোদন করতে পারছেন চেয়ারম্যান।
জানতে চাইলে চেয়ারম্যান জোবায়দুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি কোনো মেমো উপস্থাপনে হস্তক্ষেপ করিনি। আমি ব্যাংকের কোনো কাজেও হস্তক্ষেপ করি না।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাকে ব্যাংকের পুনরুদ্ধারের যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমি শুধু সেই দায়িত্বই পালন করছি। এর বেশি কিছুই করছি না।’
এদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হন কবির আহমেদ। তিনি এবং ইসলামী ব্যাংকের এএমডি দুজনেই একসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে লেখা পড়া করেছেন।
দেশের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় লুটপাটের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরও ব্যাংকটিকে সঠিকভাবে পরিচালনায় বড় ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। বরং ব্যাংকটিতে প্রথম থেকেই দ্বন্দ্ব লেগে রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের এমডি ওমর ফারুক খান এসব বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post