প্রশান্ত কুমার বর্মণ : আমরা আজ অশ্রুসিক্ত ঘটনার সাক্ষী হলাম। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিমান বিধ্বস্ত হয়ে অপ্রত্যাশিত ও মর্মান্তিক আগুনের সূত্রপাত ঘটে। ২১ জুলাই এক হূদয়বিদারক দিন। সমগ্র দেশ তথা বিশ্বব্যাপী এই শোকে কাতর। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের সেই হতাহত এবং বাংলা মায়ের দামাল ছেলেমেয়েদের রক্তের দাগ এবং আত্মত্যাগী শহিদের প্রতি কাতরতা কমতে না কমতেই আরেকটা মর্মান্তিক জুলাইয়ের আবর্তন। এ যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা। ঢাকার উত্তরায় অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশে যখন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছিল, ঠিক তখনই এক বিভীষিকাময় বিমান দুর্ঘটনা হয়ে শিক্ষার্থীদের অনাগত ভবিষ্যতের সেই স্বপ্নকে তছনছ করে দিল নিমিষেই। ফলে প্রাণ গেল স্কুলের কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের। এতে ত্রিশের অধিক শিক্ষার্থী-শিক্ষক নিহত এবং অনেকে হতাহত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তাদের অনেকের অবস্থা আবার শোচনীয়। এতে মা-বাবা তাদের আদরের সন্তান হারালো এবং কোমলমতি শিক্ষার্থীরা হারালো তাদের সহপাঠীদের। সমগ্র দেশের জনগণ আজ দুঃখে ভারাক্রান্ত। এই অকস্মাৎ দুর্ঘটনাকে কেউ সহজে মেনে নিতে পারছে না কোনোভাবেই। কারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের কাতর আওয়াজ এবং ঝলসানো দেহের হূদয়বিদারক কষ্ট ও আহাজারি আমাদের মনে বারবার যেন পীড়া দিচ্ছে। এমন মৃত্যু যেন কারও না হয়।
পাইলট তৌকির ইসলামের প্রশিক্ষণরত এফ-৭ বিজিআই বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রশিক্ষণের উদ্দেশে ছাড়লে যান্ত্রিক ত্রুটি এবং সেকেলের বিমানটি হঠাৎ মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দালানের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। হয়তোবা পাইলট বিমানটিকে নিরাপদ স্থানে অবতরণ করতে চাইলেও কিছুতেই নিজ আয়ত্তের মধ্যে বিমানের নিয়ন্ত্রণ আনতে সক্ষম হয়নি। ফলস্বরূপ হাজারো শিক্ষার্থীদের ওপর হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ের মতো এক দুর্বিষহ কালো অধ্যায় নেমে আসে। কারোর কোনো কিছু উপলব্ধি করার আগেই দুর্ঘটনাটি ঘটে। তৎক্ষণাৎ মৃত্যুপুরীতে রূপ নেয় মাইলস্টোন কলেজ এবং সমগ্র দেশে মৃত্যুর বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায়। এটা শুধু মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুর্ঘটনা নয় বরং পুরো দেশ ও জাতির হূদয়ের ক্ষত। শিক্ষার্থীদের বুক ভরা আশা আর স্বপ্ন ছিল। কে জানত, ২১ জুলাই হবে তাদের জীবনের শেষ দিন এবং শেষ মুহূর্ত? যেখান শিক্ষার্থীদের স্বপ্ন ছিল বই, খাতা, কলম আর ভবিষ্যৎ স্বপ্নের—ঠিক সেখানেই লাশ হতে হলো তাদের। অপমৃত্যু হলো তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নের। কেউ কেউ হতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, কেউবা আবার পাইলট। হঠাৎই সেসব স্বপ্নের যবনিকাপাত হয়ে মৃত্যুর মিছিলের সারথি হয়ে গেল একেকটা স্বপ্নবাজ ও তাজা প্রাণ। হাসপাতালে আহতদের চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ, বেঁচে থাকার আকুল আবেদন ও আকুতি। নিহত সন্তানদের পাশে হতভাগ্য বাবা-মায়েরা নিঃসঙ্গতা আর এক বুক কষ্ট নিয়ে অনবরত কেঁদেই চলছে। এই সীমাহীন কষ্ট থামবার নয়। কারণ কিছু শিক্ষার্থীর দেহ এমনভাবে পুড়েছে, সন্তানদের শেষবারের মতো অক্ষত অবস্থায় দেখার সেই সৌভাগ্যটুকু হয়নি নিরীহ বাবা-মায়ের।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হঠাৎ বিমান বিধ্বস্ত হওয়া শুধু যান্ত্রিক ও কারিগরি ত্রুটি নয় বরং এটি বিমানের অব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার ঘাটতিরও স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। সরকার এবং বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন রইল—জনসমাগম এলাকায় প্রশিক্ষণরত বিমান কিংবা হেলিকপ্টার যেন উড্ডয়ন করা না হয়। অতীতে এমন দুর্ঘটনার অনেক প্রমাণ আছে আমাদের দেশে। এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে গুরুদায়িত্ব হচ্ছে আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা কি পারি না, এই দুর্বিষহ সময়ে আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়াতে? কারণ আমাদের একটু সাহায্যই হতে পারে আহত শিক্ষার্থীদের বেঁচে ফিরে আসার সৌভাগ্য। এ জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণের উচিত বিভিন্ন উপায়ে তাদের সাহায্য সহযোগিতা করা। একটি ভালো উদ্যোগ কারও চোখের জল থামাতে পারে এমনকি কারও জীবন বাঁচানোও অসম্ভব কিছু না। তাই আসুন আমরা সবাই মিলে স্বপ্ন বুনে দিই ক্ষতবিক্ষত সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আঙিনায়। এ ক্রান্তিলগ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রক্ত। অনেক শিক্ষার্থী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে শরীরের ক্ষত নিয়ে। রক্ত স্বল্পতার কারণে অনেকের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। তাই আমরা যারা বিশেষ করে ঢাকার মধ্যে অবস্থান করছি; তাদের একটু সহানুভূতির হাত বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, অনেক শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনগণ রক্ত দানে এগিয়ে এসেছে। নিশ্চয় এটি একটা প্রশংসনীয় উদ্যেগ। তবে এটা যেন শেষ সময় পর্যন্ত অব্যাহত থাকে সেই বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আমার আকুল আবেদন, প্রত্যক্ষভাবে যত দ্রুত সম্ভব আহত ও নিহতদের পাশে দাঁড়ানো। দুর্ঘটনার শিকার হওয়া শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার সম্পন্ন ব্যয়ভার সরকারের নেয়া উচিত এবং সেই সঙ্গে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সম্মিলিত সহায়তাও জরুরি। নইলে আহত শিক্ষার্থীদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন হবে। এই মুহূর্তে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা অতি আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। করণীয়গুলোর মধ্যে হলো: প্রথমত যথাসম্ভব হাসপাতালগুলোয় গিয়ে প্রয়োজনীয় রক্ত, ওষুধ, খাবার ও অর্থের প্রয়োজন মিটানো। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন স্বাস্থ্যকর্মী ও সমাজকর্মীদের এগিয়ে আসার আহ্বান। তৃতীয়ত, সক্রিয় রক্তদান এবং স্বেচ্ছাসেবকমূলক সংগঠনকে এগিয়ে আসতে হবে। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বলতে গেলে—আমাদের দেশের সকল নাগরিকদের সঠিক নিরাপত্তার ব্যাঘাত ঘটছে। তাই তো প্রায়ই দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন, ডাকাতি, চুরি-ছিনতাই, ধর্ষণের মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটেই চলেছে। তাই উক্ত পরিস্থিতি বিবেচনা করে দেশের আনাচে-কানাচে সঠিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেয়া সরকারের উচিত এবং সেইসাথে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আরও উন্নতিসাধন করতে হবে। কারণ একটি শিশু যেখানে তার ক্লাসরুমে বসে থাকতে গিয়ে প্রাণ হারিয়ে ফেলে, সেখানে আমাদের নিরাপত্তা কোথায়। কাজেই এই দুর্ঘটনার কিছুটা দায় আমাদের রাষ্ট্রের নিতে হবে। পরিশেষে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই কাতর মুহূর্তে তাই আসুন, আমরা সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াই এবং পরে এমন কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন যাতে না হই, সবাই মিলে আমরা সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই প্রার্থনা করি।
শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়