প্রতিনিধি, চট্টগ্রাম : দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত পেট্রোলিয়াম পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুড তেল পরিশোধের ক্ষমতা রাখে। স্বাধীনতার পর থেকে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়নি। ২০১২ সালে সম্প্রসারণ প্রকল্প শুরু হলেও ১৩ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
প্রতিষ্ঠানটি নিয়ন্ত্রণ করে দেশের পেট্রোলিয়াম জ্বালানি আমদানি, পরিশোধন ও বিপণন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। স্বাধীনতার ৪১ বছর পরে ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ প্রকল্পটি হাতে নেয় বিপিসি। বর্তমানে ‘মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড এক্সপানশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল-২)’ নামে ৪৩ হাজার কোটি টাকার একটি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায়।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে নগরীর গুপ্তখাল এলাকায় ইস্টার্ন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর বর্তমান প্ল্যান্টটি স্থাপিত হয়। ১৯৬৮ সালের ৭ মে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করে এই রিফাইনারি। ফ্রান্সের টেকনিপ প্ল্যান্টটি নির্মাণ করে।
ইআরএল সূত্রে জানা যায়, ইআরএল-২ প্রকল্পটি চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা প্রতি বছর ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। এতে মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। ইআরএল-২ এর মাধ্যমে ফিনিশড প্রোডাক্ট হিসেবে এলপিজি, গ্যাসোলিন ইউরো-৫, জেট এ-১, ডিজেল ইউরো-৫, গ্রুপ-৩ বেজ অয়েল, ফুয়েল অয়েল, বিটুমিন ও সালফার পাওয়া যাবে।
পরবর্তী সময়ে জ্বালানি সক্ষমতা ও নিরাপত্তা বাড়াতে ইস্টার্ন রিফাইনারির বর্তমান স্থাপনার মধ্যে ৩০ লাখ মেট্রিক টন সক্ষমতার ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট-২’ প্রকল্পটি হাতে নেয় বিপিসি। ২০১২ সালে প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। শুরুর দিকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা প্রকল্প ব্যয় ধরা হলেও ২০১৬ সালে একাধিক সংশোধন হয়ে ১৬ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রকল্পের ফিড কন্ট্রাক্টর হিসেবে ফ্রান্সের টেকনিপকে নিয়োগ দেয়া হয়। টেকনিপ প্রকল্পটির (ইআরএল-২) ডিজাইন সম্পন্ন করে।
প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট (পিএমসি) হিসেবে নিয়োগ পায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড (ইআইএল)। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। ওইদিন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, পরবর্তী বছরের মধ্যেই ইআরএল-২ প্রকল্পের ভৌত কাজ শুরু হবে। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরে বেশি সময় পেরুলেও প্রকল্পের মূল কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।
সময় গড়ানোর কারণে প্রকল্প ব্যয়ও বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আবারও সংশোধন করে ২০২২ সালের শেষের দিকে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ২৩ হাজার ৫৮ কোটি ৯৩ লাখ ৯২ হাজার টাকা। প্রকল্প ব্যয়ের ৭০ শতাংশ জিওবি এবং ৩০ শতাংশ বিপিসির নিজস্ব অর্থে ব্যয় করার প্রস্তাব করা হয়। এতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি সরকারি জিওবি খাত থেকে ১৬ হাজার ১৪২ কোটি ৯৯ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে অনুমোদন দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। অবশিষ্ট ৬ হাজার ৯১৬ কোটি ৯২ লাখ ৯৩ হাজার টাকা বিপিসির নিজস্ব অর্থায়ন থেকে ব্যয় মেটানোর কথা ছিল।
২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্প প্রস্তাবনাটি আবারও সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি ১০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ হিসেবে জিওবি ফান্ড থেকে ১৬ হাজার ৬৩৫ কোটি ২৬ লাখ ৭৯ হাজার টাকা এবং বিপিসির নিজস্ব তহবিল থেকে ৩০ শতাংশ হিসেবে ৭ হাজার ১০০ কোটি ৮৩ লাখ ৮৪ হাজার টাকা অর্থায়নের একটি প্রস্তাবনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা দেয় জ্বালানি বিভাগ।
প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষমাণ থাকা অবস্থায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে প্ল্যান্টটি নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করে ২০২৩ সালের ২৯ জানুয়ারি এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম স্বাক্ষরিত এক পত্রের মাধ্যমে সমঝোতা স্মারকের একটি প্রস্তাবনা জমা দেন। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তে ইআরএল-২ প্রকল্পটি আবারও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় বিপিসি।
ইআরএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ নাসিমুল গণি গত ১ জুলাই ইস্টার্ন রিফাইনারিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের সার্বিক জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারি-২ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অগ্রগতি হয়েছে। নতুন করে ডিপিপি তৈরি করা হয়েছে। ডিপিপিটি মন্ত্রণালয়ে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য রয়েছে।
এদিকে গত ১১ আগস্ট ‘মর্ডানাইজেশন অ্যান্ড এক্সপানশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)’ নামে পুনর্গঠিত ডিপিপি জ্বালানি ও খনিজ বিভাগে পাঠিয়েছে বিপিসি। এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান স্বাক্ষরিত চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, নতুন ডিপিপিতে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার ৮৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়নে ঋণ হিসেবে ৬০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৪০ শতাংশ বিপিসির নিজস্ব আয় থেকে বহন করা যেতে পারে।
সে হিসাবে প্রাক্কলিত ব্যয়ের ২৫ হাজার ৮৫২ কোটি ৫১ লাখ টাকার জিওবি এবং অবশিষ্ট ১৭ হাজার ২৩৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা বিপিসি বহন করবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০৩০ সালের আগস্ট পর্যন্ত মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের অর্থ সংস্থানের জন্য ইতোমধ্যে এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্ট ব্যাংক (আইইইবি), সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), চীন, জাপান, কুয়েত, ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকসহ (আইডিবি) কয়েকটি দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানা যায়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ১২ বছর ধরে ঝুলে আছে ইআরএল-২ প্রকল্পটি। এটি হলে জ্বালানি নিরাপত্তায় আমাদের রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা অনেক এগিয়ে যেত। আগের প্রস্তাবনায় লাইট ক্রুড প্রসেসিংয়ের প্রস্তাব ছিল। নতুন ডিপিপিতে বিটুমিনাস ক্রুডসহ হেভিক্রুড প্রসেস করার সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। তাছাড়া ২৩ হাজার টাকার প্রকল্পটি যখন ছিল তখন ডলার ছিল ৯০ টাকার মতো। এখন ডলারের মূল্য ১২২ টাকার মতো। আগে খরচ কম দেখিয়ে প্রকল্প অনুমোদনের একটি চাপ ছিল। এখন সরকার স্বচ্ছতার ভিত্তিতে প্রকল্পের ডিপিপি করতে আগ্রহী। যে কারণে প্রকল্পের ব্যয় অনেক বেড়েছে।

Print Date & Time : 17 August 2025 Sunday 6:36 am
১৩ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি ইআরএল-২ প্রকল্প
অর্থ ও বাণিজ্য,পত্রিকা,শেষ পাতা ♦ প্রকাশ: