নিজস্ব প্রতিবেদক : ইউনিসেফ ও অন্য অংশীদারদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে শিশু ও নারীদের ওপর পরিচালিত জরিপ ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫ (এমআইসিএস ২০২৫)’-এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করেছে। গতকাল রোববার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়। জরিপের ফলাফলে বলা হয় দেশে প্রতিবছর শিশুশ্রমে যুক্ত হচ্ছে ১২ লাখ শিশু। আর প্রতি ১০ জন শিশুর চারজনের রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রায় সিসা পাওয়া গেছে। পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার, বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এবং বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গতকাল বিবিএসের এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানোনো হয়।
প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর ভিত্তি করে এ জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা ও বিকাশে বিদ্যমান অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এটি জাতীয় অগ্রাধিকার ও বৈশ্বিক মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতি রেখে ১৭২টি মানদণ্ড এবং ২৭টি এসডিজি সূচককে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, ‘এমআইসিএস ২০২৫ বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসেছে এবং এটি অগ্রগতি ও চলমান চ্যালেঞ্জ উভয়েরই প্রতিফলন।’ তিনি বলেন, ‘বাল্যবিয়ে ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস প্রমাণ করে, অগ্রগতি সম্ভব। কিন্তু সিসাদূষণ ও শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে তাদের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে। যখন প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকা, বিকশিত হওয়া ও শেখার অধিকারকে সম্মান করা হবে, তখন এটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশের মাধ্যমে পরিমাপ করা যাবে।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব আলেয়া আক্তার বলেন, এবারের এমআইসিএস আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও প্রাসঙ্গিক, কারণ এতে প্রথমবারের মতো গর্ভবতী নারী এবং অল্পবয়সী শিশুদের মধ্যে অ্যানিমিয়া (রক্তস্বল্পতা) ও ভারী ধাতু দূষণের মাত্রা পরীক্ষার নতুন মডিউল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশের এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় আট শতাংশের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি। ঢাকা (৬৫ শতাংশ) সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত এলাকা।
জরিপে অপুষ্টি বৃদ্ধির বিষয়টি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, কম ওজনের শিশুর হার ২০১৯ সালে যেখানে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল, তা বেড়ে ২০২৫ সালে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে পৌঁছেছে। মায়েদের অ্যানিমিয়া বা রক্তস্বল্পতা এখনও অত্যন্ত উচ্চ হারে, ৫২ দশমিক ৮ শতাংশ রয়েছে এবং কিশোরী জš§হার (প্রতি এক হাজার মেয়ের মধ্যে) ৮৩ থেকে বেড়ে ৯২ হয়েছে।
জরিপে বলা হয়, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার এখন ৯ দশমিক ২ শতাংশ, যা ২০১৯ সালের ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়েছেÑফলে আরও ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিতে পড়েছে। সহিংসতাও ব্যাপক, সাম্প্রতিক সময়ে ৮৬ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো ধরনের সহিংস আচরণের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ের হার ২০১৯ সালের ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে, তবে এখনও প্রায় অর্ধেক মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
জরিপে উল্লেখ করা হয়, প্রতি এক ডলার বিনিয়োগে ৯ গুণ সামাজিক ও অর্থনৈতিক লাভ পাওয়া যায়। শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা, সামাজিক সেবা সম্প্রসারণ এবং কিশোর-কিশোরীদের ক্ষমতায়নের জন্য জরুরি বিনিয়োগের প্রয়োজন, যাতে সব শিশু নিরাপদভাবে বেড়ে উঠতে পারে এবং তাদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
জরিপের তথ্যানুযায়ী স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ৭৫ শতাংশে প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশনের হার বৃদ্ধি স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক চাপÑউভয়ই বাড়াচ্ছে। মাত্র ৪৬ শতাংশ নারী গর্ভধারণের প্রথম চার মাসের মধ্যে প্রসব-পূর্ব সেবা (অ্যান্টেনাল কেয়ার) গ্রহণ করেন, যা মাতৃ স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছে। গর্ভধারণের প্রথম থেকেই মাতৃসেবা জোরদার করা নবজাতকদের জন্য স্বাস্থ্যকর শুরুর নিশ্চয়তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জরিপে বলা হয়, স্যানিটেশন সেবায় প্রবেশাধিকার বেড়ে ৭৩ শতাংশে পৌঁছেছে, কিন্তু নিরাপদভাবে পরিচালিত পানীয় জলের হার ৩৯ দশমকি ৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যেখানে ব্যাপক ব্যাকটেরিয়া দূষণ বিদ্যমান। এর অর্থ হলো বাংলাদেশের ১০ কোটিরও বেশি মানুষ নিরাপদভাবে পরিচালিত পানীয় জলের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
এছাড়া পানীয় জলের প্রায় অর্ধেক উৎস এবং গৃহস্থালিতে ব্যবহƒত পানির ৮০ শতাংশের বেশি নমুনা ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা দূষিত। গত বছরে জলবায়ু-সম্পর্কিত বিপদ ১০ দশমিক ২ শতাংশ পানির উৎসকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, যা জলবায়ু-সহনশীল অবকাঠামোর প্রয়োজনীয়তাকে আরও স্পষ্ট করেছে।
জরিপে আরো বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির উচ্চ হার (৮০ শতাংশ) বজায় থাকলেও উচ্চতর
স্তরে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার তীব্রভাবে কমেছে। অনেক শিশু মৌলিক দক্ষতা অর্জন ছাড়াই প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করছে এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়গামী বয়সী শিশুদের প্রায় ছয় থেকে সাত শতাংশ স্কুলের বাইরে থেকে যাচ্ছে। শিশুদের স্কুলে উপস্থিতি ও মৌলিক লেখাপড়া নিশ্চিত করার জন্য উদ্ভাবনী পদ্ধতির প্রয়োজন।
