নিজস্ব প্রতিবেদক : একীভূতকরণের প্রক্রিয়ায় থাকা পাঁচ ইসলামী ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিপূরণ পাবেন কি নাÑএ নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে স্পষ্ট অবস্থান না থাকায় শেয়ারহোল্ডারদের উদ্বেগও বাড়ছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও সংস্থাগুলোর বক্তব্যে মিল না থাকায় তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। পাঁচ ব্যাংক হলোÑফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংক।
গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি এবং অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ পাঁচ ব্যাংকের বিষয়ে কথা বললেও শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান জানাননি।
শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘দেখি ওদের ব্যাপারে কী করা যায়।’ ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীরা আদৌ ক্ষতিপূরণ পাবেন কি নাÑএমন প্রশ্নে তিনি পাল্টা মন্তব্য করেন, ‘এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রশ্ন করুন।’
সাংবাদিকরা জানান, বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে বলেছে, সরকার বিষয়টি বিবেচনা করবে। জবাবে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা বিবেচনা করব, জয়েন্টলি দেখব। একেবারে ইগনোর করছি না।’ তবে ক্ষতিপূরণ পাবেন কি নাÑগতকাল এই সরাসরি প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা এখন আমি বলব না।’
একীভূতকরণের গুঞ্জন ছড়িয়ে পাঁচ ব্যাংকের শেয়ার শূন্য হয়ে যেতে পারেÑএমন ধারণা বাজারে ছড়িয়ে পড়ার পর শেয়ারের দামে বড় ধরনের ধস নামে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ১২ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয় একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, একীভূতকরণের কারণে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেÑএমন গুজব ছড়ানো হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত সরকার নেয়নি বলেও জানানো হয়।
পরে ৫ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাঁচ ব্যাংকের শেয়ারহোল্ডারদের ইক্যুইটি এখন শূন্যের নিচে। ফলে শেয়ারগুলোর মূল্য ‘জিরো’ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না।
তবে পরদিন ৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সরকার বিবেচনা করতে পারে।
সবশেষ ৯ নভেম্বর সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় ও অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির বৈঠকের পর সাংবাদিকরা ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে আবারও অর্থ উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘গভর্নর যা বলেছেন সেটা ফাইনাল না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবে সরকার। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি।’
ফলে পাঁচ ব্যাংকের সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের ক্ষতিপূরণ হবে কি হবে নাÑতা এখনও অনিশ্চিতই রয়ে গেছে।
এদিকে একীভূত হওয়া ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এসআইবিএল), এক্সিম ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক ও ইউনিয়ন ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা ও ধসের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে চায় সরকার। এ বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংককে আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর মালিক, পরিচালনা পর্ষদের সদস্য, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে খেলাপি ঋণ ও বিনিয়োগ পুনরুদ্ধারের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ীÑএই পাঁচটি সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংক একীভূত হয়ে নতুন ব্যাংক গঠন করবে। নতুন ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি দেবে সরকার এবং আমানতকারীদের ১৫ হাজার কোটি টাকা রূপান্তর করা হবে শেয়ারে।
এর আগে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা বিপর্যস্ত পাঁচ ব্যাংকের ক্ষুদ্র শেয়ারধারীদের স্বার্থ রক্ষায় ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে পারে সরকার। তবে সাধারণ শেয়ারধারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ আপাতত নেই বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছিল।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক উত্তমচর্চার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এফসিডিওর কারিগরি সহায়তা ও মতামত নিয়ে ‘ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইনে রেজল্যুশন প্রক্রিয়ায় আমানতকারী, শেয়ারহোল্ডারসহ সব পাওনাদারের অধিকার স্পষ্টভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্যাংক পাঁচটি হলোÑফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংক।
অধ্যাদেশের ধারা ১৬(২)(ট), ২৮(৫), ৩৭(২)(গ) ও ৩৮(২) অনুযায়ী, রেজল্যুশনের আওতাধীন ব্যাংকের শেয়ারধারক, দায়ী ব্যক্তি, অ্যাডিশনাল টিয়ার-১ ও টিয়ার-২ মূলধনধারকদের ওপর লোকসান আরোপের ক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের।
তবে ধারা ৪০ অনুযায়ী, রেজল্যুশনের বদলে যদি কোনো ব্যাংক অবসায়নের মুখে পড়ত আর সেই অবস্থায় শেয়ারহোল্ডারদের যে ক্ষতি হতো তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হলে, সেই পার্থক্যের ক্ষতিপূরণ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তখন আরও জানায়, আন্তর্জাতিক কনসালটিং ফার্মের এ-কিউ-আর ও বিশেষ পরিদর্শনে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, উল্লিখিত পাঁচ ব্যাংক বিশাল লোকসানে রয়েছে এবং তাদের শেয়ারপ্রতি সম্পদমূল্য ঋণাত্মক।
এসব বিবেচনায় চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ব্যাংকিং সেক্টর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়Ñসংকটাপন্ন ব্যাংকগুলোর মোট লোকসানের দায়ভার শেয়ারহোল্ডারদেরই বহন করতে হবে।
প্রিন্ট করুন










Discussion about this post