মো. মনিরুল হক : দেশের প্রথম নারীকেন্দ্রিক বেসরকারি বিশ্বব্যিালয় সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষকদের বেতনে গত আট বছরে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ সময়ে মূল্যস্ফীতির চাপ তীব্র আকার ধারণ করায় তাদের জীবনে নেমে এসেছে চরম হতাশা।
এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, বেতন বৃদ্ধি না হওয়ায় তাদের পক্ষে বর্ধিত খরচ বহন করা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। এসব কারণে তাদের পক্ষে আগের মতো উৎসাহ নিয়ে পাঠদান করা সম্ভব হচ্ছে না।
জানা গেছে, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির একজন প্রভাষকের বেতন শুরু হয় মাত্র ৩৫ হাজার টাকা থেকে। প্রতি বছর বেতন ইনক্রিমেন্ট দেয়া হয় ৫০০ টাকা করে। ফলে পাঁচ থেকে ১০ বছর চাকরি করার পরেও একজন শিক্ষকের বেতন দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকায়। এই বেতন কাঠামো শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন তারা।
বাংলােেশর অন্যান্য বেসরকারি বিশ্বব্যিালয়ের বেতন কাঠামোর সঙ্গে তুলনা করলে অনেক পিছিয়ে আছে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির বেতন কাঠামো। যেমন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে (ইউল্যাব) শিক্ষকদের বেতন শুরু হয় প্রায় ৪০ হাজার টাকা থেকে। বছরে দু-তিন হাজার টাকা ইনক্রিমেন্ট পান তারা। ফলে তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যেই তাদের বেতন দাঁড়ায় ৫০-৬০ হাজার টাকায়।
অন্যদিকে দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি বিশ্বব্যিালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ) ও ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে একজন শিক্ষকের বেতন শুরু হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা থেকে। কয়েক বছরের মধ্যেই ইনক্রিমেন্টে বেতন দাঁড়ায় ৭০-৮০ হাজার টাকায়।
অভিযোগ উঠেছে, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি পরিচালনার ক্ষেত্রে আর্থিক স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। শিক্ষকেরা জানান, কাজী ফার্মস গ্রুপ একটি লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলেও তার মালিকানাধীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন দেয়া হচ্ছে না। শিক্ষকরা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করা একটি কোম্পানির শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধিতে এমন মনোভাব কেন?’
এই পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা মনে করেন, প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষরে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তাদের পাঠদানের ওপর।
বিশেষজ্ঞরে মতে, শিক্ষা খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সবার আগে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষক। অথচ বেতন বৃদ্ধির এমন মন্দা নীতি দক্ষ জনশক্তিকে পেশা পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
‘আমরা শুধু টিকে থাকার জন্য কাজ করছি। পরিবার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ অনান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পদের শিক্ষক দ্বিগুণ বেতন পাচ্ছেন।’
এ ধরনের আর্থিক অব্যবস্থাপনা ও অবহেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। এই অবস্থা চলমান থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ও শির্ক্ষাীদের ভর্তির হারেও প্রভাব ফেলতে পারে।
এ অবস্থার পরিবর্তনে সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির শিক্ষকেরা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ আশা করছেন। তারা একটি সুন্দর বেতন কাঠামো, স্বচ্ছতা ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্টে বাস্তবসম্মত পরিবর্তন চান।
তারা আরও বলেন, ‘প্রতি বছর শুধু ৫০০ টাকা ইনক্রিমেন্ট কেবল অপমানজনকই নয়, এটি আমারে দীর্ঘমেয়াদি পেশাগত উন্নয়নের পথে বড় বাধা।’
অভ্যন্তরীণ সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষা খাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিষ্ঠানটি মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যেই শিক্ষকদের বেতন বছরের পর বছর অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।
এ অবস্থায় দেশের উচ্চশিক্ষা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উচিত বেসরকারি বিশ্বব্যিালয়গুলোর আর্থিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত নজরদারি চালানো, যাতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা পান।
একটি দেশের উন্নয়নে উচ্চশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। সেখানে শিক্ষকদের মূল্যায়ন না হলে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি সম্ভব নয়। কাজী ফার্মস গ্রুপের মতো প্রতিষ্ঠানের উচিত শিক্ষা খাতে বিনিয়োগকে শুধু ব্যয় নয়, বরং ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হিসেবে দেখা। অন্যথায়, এ ধরনের অবহেলা একসময় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটির এইচআর বিভাগের কর্মকর্তা মো. মামুন বলেন, ‘আসলে ইউনিভার্সিটির তো আমি কিছু নই, রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলেন। বাড়ে কি বাড়ে না, এটা আপনি কী জানেন, কীভাবে জানেন বলেন? এ কথাটাও সঠিক নয় যে বাড়ে না। আপনি কি জানেন ইনক্রিমেন্ট ৫০০ টাকা কি না? এ তথ্য সঠিক নয়।’
রেজিস্ট্রার ইলিয়াস আহমেদ এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তিনি চেয়ারম্যান ড. পারভীন হাসানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পারভীন হাসানও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ট্রেজারার ড. আহমেদ আবদুল্লাহ জামাল বলেন, ‘প্রতি বছর ইনক্রিমেন্ট হয়। ৫০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকা, এটা শিক্ষকভেদে কমবেশি হয়।’ এর বেশি তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।

Discussion about this post