নিজস্ব প্রতিবেদক : দীর্ঘ ৯ বছর পর সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণে পে কমিশন গঠন করেছে সরকার। সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে নতুন এই বেতন কমিশনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং এ তথ্য জানিয়েছে।
বর্তমানে ২০১৫ সালের পে স্কেল অনুসারে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পান। দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন প্রায় ১৫ লাখ।
চড়া মূল্যস্ফীতিতে জীবযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনায় ছিল নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণার দাবি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সরকারি চাকরিজীবীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়ার দাবি আলোচনায় আসে।
জুনে ঘোষিত নতুন অর্থবছরের বাজেটে মহার্ঘ ভাতার বিষয়ে ঘোষণা আসার আশায় ছিলেন অনেকেই। তবে তার বদলে বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। এই সুবিধা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়।
সরকারি চাকরিজীবীদের বিশেষ প্রণোদনার হার আগের পাঁচ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে গত ৩ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ১০ম থেকে ২০তম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এই পাঁচ শতাংশসহ মোট ১৫ শতাংশ এবং ১ম থেকে ৯ম গ্রেডভুক্ত কর্মকর্তারা মোট ১০ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা পাবেন।
এর আগে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বার্ষিক পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্টের পাশাপাশি অতিরিক্ত পাঁচ শতাংশ হারে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দেশে সর্বশেষ ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য অষ্টম বেতন কাঠামো ঘোষণা করে সরকার। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পর নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা হওয়ার কথা।
অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল প্রদানের পর গত ৯ বছরে বিদ্যুৎ, পানি, ওষুধ, চিকিৎসা, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম প্রায় ৭০ শতাংশের মতো বেড়েছে। এর বিপরীতে সরকারি চাকরিজীবীদের ৯ বছরে পাঁচ শতাংশ হারে মোট ৪৫ শতাংশ বেতন বেড়েছে।
২০১৫ সালের পে স্কেল অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২০টি বেতন গ্রেড রয়েছে। এ কাঠামোতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদে যোগ দেয়া একজন চাকরিজীবীর মূল বেতন হয় মাসে ২২ হাজার টাকা।
সরকারি চাকরিজীবীরা মূল বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত বাবদ আলাদা ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পান।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ৮৪ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।
৯ বছর পর জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাধীন কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের জন্য একটি নতুন বেতন কমিশন গঠন করল সরকার। বেতন কমিশন ছয় মাসের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন জমা দেবে।
জানা গেছে, সরকারি চাকরি ২০ গ্রেডে চারটি শ্রেণিতে বিভক্ত। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণি ১ম থেকে ৯ম গ্রেড এবং দ্বিতীয় শ্রেণি হলো ১০ম গ্রেড। শুধু ১০ম গ্রেডই দ্বিতীয় শ্রেণি। ১১ থেকে ১৬তম গ্রেড তৃতীয় শ্রেণি এরপর ১৭ থেকে ২০তম গ্রেড হলো সর্বশেষ চতুর্থ শ্রেণি।
১ থেকে ৯নং গ্রেডে যারা, তারা প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা বা গেজেটেড অফিসার বা ক্যাডার। তাদের নিয়োগের সময় সরকারি গেজেট বা বিজ্ঞপ্তি বের হয়, স্বয়ং প্রেসিডেন্ট তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সামগ্রিক দিক বিবেচনায় মানমর্যাদা, দায়িত্ব-কর্তব্যের পরিধি এবং সুযোগ-সুবিধার দিক দিয়ে প্রথম শ্রেণির গেজেটেড অফিসাররা তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থানে থাকেন। তার ওপরে আছে সচিব/মুখ্য সচিব।
এছাড়া পিএসসি কর্তৃক নিয়োগকৃত ২৭ ধরনের চাকরিকে ক্যাডার এবং পিএসসি কর্তৃক নিয়োগকৃত অন্যান্য সরকারি চাকরিকে নন-ক্যাডার জব বলা হয়।
নন-ক্যাডার জব গ্রেড ৯ হলে ১ম শ্রেণি এবং গ্রেড ১০ হলে ২য় শ্রেণি বলা হয়। ক্যাডার আর নন-ক্যাডার জবের মধ্যে মূল পার্থক্য হলো, ক্যাডাররা প্রমোশন পেয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে যেতে পারেন, যা নন-ক্যাডাররা যেতে পারেন না। প্রায় সব ক্যাডারই কমপক্ষে সর্বোচ্চ গ্রেড পর্যন্ত যেতে পারেন, অন্যদিকে নন-ক্যাডারে বেশির ভাগ পদই ব্লক পোস্ট।
সরকারি যে কোনো অফিসে চার ধরনের স্টাফ থাকে, যাদের মধ্যে রয়েছে ক্যাডার, তার নিচে কর্মকর্তা তার নিচে কর্মচারী। তাদের মাঝে ১ম, ২য় এদের গেজেটেড কর্মকর্তা বলা হয়। ৩য় শ্রেণির যারা তারাও হলেন কর্মকর্তা। ৪র্থ শ্রেণির যারা তারা হলেন কর্মচারী।
প্রথম শ্রেণি মানেই ন্যূনতম ৯ম গ্রেড আর দ্বিতীয় শ্রেণি কেবল ১০ম গ্রেড। আর সব ডিপার্টমেন্টের সহকারী পরিচালক প্রথম শ্রেণির। বাংলাদেশ ব্যাংকের এডি না, সব এডিই প্রথম শ্রেণির।
পুলিশের এসআই দ্বিতীয় শ্রেণির এবং প্রাইমারি প্রধান শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণির। সরকারি হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক দ্বিতীয় শ্রেণির।
প্রাইমারি সহকারি শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণির এবং সব ডিপার্টমেন্টের অফিস সহকারী, কম্পিটার অপারেটর/ষাট মুদ্রাক্ষরিক তৃতীয় শ্রেণির। অফিস সহায়ক চতুর্থ শ্রেণির, যার স্কেল ৮ হাজার ২৫০, যেমন প্রাইমারি স্কুলের পিয়ন।
অষ্টম জাতীয় পে স্কেলে ২০টি গ্রেডে সর্বোচ্চ মূল বেতন ৭৮ হাজার টাকা হলেও এই স্কেলের বেতন ভাতাসহ অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। একইভাবে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ৮ হাজার ২৫০ টাকা হলেও সব মিলে দাঁড়াবে ২০ হাজার ১০ টাকা।
প্রথম স্কেলে বাড়িভাড়া করা হয়েছে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ বা ৪০ হাজার টাকা। এর পাশাপাশি চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, ডোমেস্টিক এইড ভাতা ৩ হাজার টাকা, উৎসব ভাতা ১৩ হাজার ৩৩ টাকা, আপ্যায়ন ভাতা ৩ হাজার টাকা ও শিক্ষা ভাতা ২ হাজার টাকা করা হয়েছে।
একইভাবে সর্বনিম্ন স্কেলের বাড়িভাড়া করা হয়েছে ৫ হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ১ হাজার ৫০০ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩০০ টাকা, সন্তানের শিক্ষা ভাতা ২ হাজার টাকা, ধোলাই ভাতা ১৫০ টাকা ও টিফিন ভাতা ৩০০ টাকা।