জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সবুজ উদ্ভিদের বিকল্প নেই
শিশির রেজা
বিভীষিকাময় অন্ধকার ও আলোর অন্তরিক্ষ। প্রায় ৭৮০ কোটি মানুষ বসবাস করছে ১৯৫টি দেশে। ১০ হাজার ১২৪টি ধর্মে বিভক্ত মানুষ কথা বলছে প্রায় তিন হাজার ৫০০টি ভাষায়। মানুষ চিন্তা করছে, গবেষণা করছে, যুদ্ধ করছে, অধিকার আদায় করছে, খাদ্য উৎপাদন করছে এবং সমাজের শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী হিসেবে এগিয়ে চলেছে।
দ্বিজেন শর্মা নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে উদ্ভিদের সতেজতা-সরলতা। সবুজের হাতছানি দিয়ে তিনি মানুষকে ডেকে গেছেনÑ‘মানুষ, উদ্ভিদের মতো
আনত হও, হও সবুজ।’ এই আহ্বান আমৃত্যু জানিয়ে গেছেন তিনি।
আমরা সবাই জানি পৃথিবীর এক গোলার্ধে যখন দিন, অন্য গোলার্ধে রাত। রাতেও ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকাতে আলো, কিন্তু আফ্রিকা ও এশিয়ায় কালো। এশিয়ার দুটি পাশাপাশি দেশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দক্ষিণ কোরিয়া অনেকটাই আলোকিত, উত্তর কোরিয়াতে অন্ধকার। এর কারণ কী?
নাইজেরিয়ার একটি আমগাছের সঙ্গে ভুটানের একটি আমগাছের পার্থক্য কোথায়, কিংবা ফিজির একটি নিমগাছের সঙ্গে ওমানের একটি নিমগাছের
পার্থক্য কী? হয়তোবা বপন, বৃদ্ধিকরণ, উৎপাদন, বিতরণ ও ভোগের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকতে পারে,
কিন্তু একটি সবুজ কাঁঠাল গাছ সারা বিশ্বে কাঁঠাল গাছ নামে পরিচিত।
প্রাকৃতিক সম্পদ হিসেবে পৃথিবীর প্রতিটি উদ্ভিদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত মূল্য রয়েছে। যেমন একটি পরিপক্ব উদ্ভিদ প্রায় ৩১ হাজার ৫০০ ডলার মূল্যের অক্সিজেন উৎপাদন করতে পারে; প্রায় ৬২ হাজার ২০০ ডলার মূল্যের বায়ুদূষণ রোধ করতে পারে; প্রায় ৩৭ হাজার ৫০০ ডলার মূল্যের পানিকে বিভিন্ন প্রকারের দূষক থেকে রক্ষা করে এবং ৩১ হাজার ৫০০ ডলার মূল্যের ভূমিদূষণ রোধ করে। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক কর্মসূচি বা ইউএনইপি থেকে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি শহরে মোট ২৫ শতাংশ উম্মুক্ত ভূমি থাকা প্রয়োজন। সাধারণত এই উম্মুক্ত ভূমি বলতে সবুজ এবং জলজ ভূমির একটা সহাবস্থানকে বোঝায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়ের এক দশমিক ৭৪ শতাংশ আসে সবুজ বনজ সম্পদ থেকে।
একটি সবুজ উদ্ভিদ তার পরিচয় ব্যতিরেকেই উগান্ডাতে যে ভূমিকা পালন করছে, কাতারেও সেই একই ভূমিকা রাখছে, যেমন মানুষের খাদ্য হওয়া; পশুপাখির আশ্রয়স্থল হওয়া; বায়ু, পানি, শব্দ ও মাটিদূষণ রোধ এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করা। কখনোই একটি উদ্ভিদ অহংকার করে না যে, ‘আমি এখন অক্সিজেন উৎপাদন করব না, বা শালিক পাখিকে বাসা বাঁধতে দেব না।’
জাপানের চেরি ফুলের গাছটি যেমন সূর্যের আলো, বায়ু, পানি ও বৃষ্টির মধ্যে সামঞ্জস্য তৈরি করছে, আবার মৌরিতানিয়ার মেহগনি গাছটি মানবসমাজের বাসাবাড়ি তৈরিতে কাঠ দিচ্ছে। নানা প্রজাতির গাছ নানাভাবে মানুষের উপকার করছে। গাছ মাটি থেকে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, ডলোমাইট, বোরাইট, পটাসিয়াম, পটাশ ইত্যাদি সংগ্রহ করে কৃষিজমির উর্বরতা রক্ষা করছে।
পৃথিবীর এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা জলবায়ু পরিবর্তন। সেক্ষেত্রেও পৃথিবীর প্রতিটি উদ্ভিদ তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রকৃতিকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার জন্য।
কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী আমরা উদ্ভিদের ‘নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ থেকে শিক্ষা নিতে পারছি না। সদ্যপ্রয়াত পৃথিবীর একজন নায়ক কফি আনান বলেছেন, আমরা শরীরে, উচ্চতায় ও জাতিতে ভৌগোলিকভাবে ভিন্ন হলেও সবাই রক্তে লাল মানুষ।
মানুষের বিবেক থাকা সত্ত্বেও অপরকে সম্মান তো করেই না এবং নিজেকেও করে না। পৃথিবীর প্রতিটি দখলদার রাষ্ট্র এখন ব্যতিব্যস্ত দুর্বল রাষ্ট্রের সম্পদ ভোগদখলে নেওয়ার লিপ্সায়, বা সেই দেশের মানুষের মস্তিষ্কের ও মনের মধ্যে চিন্তার বিভাজন ঘটিয়ে দেওয়ার আকাক্সক্ষায়।
মাদার তেরেসা বলেছেন, ‘তুমি যদি মানুষের বিচার কর, তবে তুমি মানুষকে ভালোবাসতে পারবে না।’ দার্শনিক কনফুসিয়াসকে আমরা বাঁচিয়ে রেখেছি তার চিন্তার জন্য। মানুষ হিসেবে আমাদের চিন্তা করতে হবে, ‘আমরা যুদ্ধ চাই, না শান্তি চাই; আমরা কি অপরের জমি দখল করে নেব, অপরের অধিকার কেড়ে নেব, জাতিতে জাতিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগিয়ে দেব, মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে জাতি ও পরিবেশ ধ্বংস করব নাকি একটি সবুজ উদ্ভিদ থেকে শিক্ষা নিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ব।’
পরিবেশ গবেষক ও সহযোগী সদস্য
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি