প্রিন্ট করুন প্রিন্ট করুন

খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রয়োজন সহায়ক পরিকল্পনা নীতিমালা

মহিউদ্দিন আহমেদ:‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো’ বা ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’এই ধরনের প্রবাদ ব্যাংকিং খাতের জন্য প্রযোজ্য নয়। আমানত সংগ্রহ এবং ঋণ দেয়াই ব্যাংকের প্রধান কাজ। ব্যাংকিংয়ে আয়ের প্রধান উৎস হলো ঋণের বিপরীতে সুদ; যেখান থেকে আমানতকারীদের আমানত সুদ দিতে হয়, পরিচালন ব্যয় মেটাতে হয়, সব ব্যয় মিটিয়ে যা মুনাফা থাকে, তার থেকে শেয়ারহোল্ডারদের ডিভিডেন্ড দিতে হয় এবং সরকারকে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হয়। অতএব গোয়াল খালি রাখার কোনো উপায় নেই, বরং দুষ্টু গরু/খারাপ লোনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যা ব্যাংক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জও বটে।

ঋণ দেয়ার পরবর্তী কাজ ঋণ আদায়Ñএটা যতখানি সত্য, এটা খুব সহজ কাজ নয় সেটাও সত্য। দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় ২১ শতাংশ ঋণখেলাপি হয়ে গেছে, মামলা-মোকদ্দমার মাধ্যমেও এগুলো আদায় হচ্ছে না। ঋণ আদায় করতে গিয়ে ব্যাংকাররা বিভিন্ন বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি হচ্ছেন।

‘দুই ব্যাংক কর্মকর্তা গেলেন এক খেলাপি ঋণ গ্রহীতার বাসায় টাকা আদায়ের জন্য। ঋণ গ্রহীতা স্থানীয় লোকদের সঙ্গে যোগসাজশ করে চাঁদাবাজির ধোয়া তুলে গণপিটুনির আয়োজন করেছিলেন।’

বড় অঙ্কের ঋণখেলাপি একজনের কাছে যাওয়া হলো ব্যাংক থেকে ঋণ পরিশোধের তাগাদা দেয়ার জন্য, পরিবার থেকে জানানো হলো ‘উনি অসুস্থ, ডিমেনশিয়া সন্দেহ করা হচ্ছে’। ব্যাংকারের গা শিউরে উঠল, তার মানে কোন ব্যাংক থেকে কত টাকা নিয়েছেন, তা কিছুই মনে করতে পারবেন না!

 খেলাপি ঋণ গ্রাহকের কাছ থেকে সাড়া না পেয়ে ব্যাংক থেকে প্রথম জামিনদার ঋণ গ্রহীতার স্ত্রীকে ফোন দেয়া হলো। স্ত্রী ‘আজ আমার মন ভালো নাই’ টাইপ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমাদের ডিভোর্স হয়ে গেছে’! ব্যাংকার চিন্তা করছেন, লোনের টাকা না দিয়ে কেন তারা সংসার ভাঙতে গেল?

ঋণ বিভিন্ন কারণে খেলাপি হয়েছে; যেমন করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি প্রভৃতিÑএগুলো অনিয়ন্ত্রণাধীন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সময়-অসময়ে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে ব্যবসায়ীদের পাশে থেকেছেন, যদিও প্রণোদনার লোনগুলোও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনাদায়ী থাকাতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রচলিত ব্যাংক সুদে দীর্ঘমেয়াদি কিস্তি লোনে রূপান্তর করতে হয়েছে। করোনার পর বিদেশে জনবলের চাহিদা বাড়ায় এক শ্রেণির ‘স্বেচ্ছায় খেলাপি’ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, যাদের মধ্যে ব্যবসায়ী, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, উচ্চপদস্থ করপোরেট থেকে শুরু করে অসাধু ব্যাংকারও আছেন। এই টাকাগুলো আদায় যত কষ্টসাধ্যই হোক না কেন তা ফেরত আনার উপায় বের করতে হবে, কারণ এগুলো জনগণের টাকা। 

বর্তমানে ব্যাংকের অর্থ মামলা কমবেশি ২ লাখ ৭৭ হাজার, যাদের সবাই ইচ্ছাকৃত খেলাপি নয়, অনেক সময় তারা পরিস্থিতির শিকারও হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক  ড. আরএম দেবনাথ যথার্থই বলেছেন, ‘যেই অঙ্কে লোন শ্রেণিবিন্যাস/প্রভিশনিং হয়, সেই অঙ্কে ব্যবসা চলে না।’ অর্থমন্ত্রী হয়তো এ ব্যাপারটাকেই মাথায় রেখে ২০১৮ সালে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পাল্টে দিয়েছেন, ২০১৯ সালে শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ১ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ ১০ বছর মেয়াদে খেলাপি ঋণ ‘নিয়মিত’ করার সুযোগ দিয়েছেন, সর্বশেষ বিআরপিডি সার্কুলার ১৬, ২০২২-এর মাধ্যমে মাত্র ২-৪ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে পুনঃতফসিল সুবিধা ও ২০২২ সালে প্রদেয় কিস্তির অর্ধেক পরিশোধে রেগুলার হওয়ার সুবিধা দিয়েছেন এবং এই পলিসির আওতায় প্রায় ১৪ হাজার কোটি খেলাপি ঋণ কাগুজে কমে গেছে। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বরাবরই ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিংয়ে গতিশীলতা নিশ্চিত করতে ‘আন্তরিক’ প্রজ্ঞাপন জারি করছেন, তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ব্যাংকগুলোর প্রকৃত অবস্থা জানতে পারছেন না বলে ‘উষ্মা’ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল কর্তৃক ৪৭০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেয়ার প্রাক্কালে খেলাপি ঋণ নিয়ে দাতাগোষ্ঠীর অনেক উদ্বিগ্নতা সামনে এসেছে, পাশাপাশি অনেক সংস্কার পরামর্শ এসেছে, সরকারের পক্ষ থেকেও অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আগামী ২০২৬ পর্যন্ত দাতাগোষ্ঠীর নজর থাকবে এই অবস্থায় উন্নয়নে সরকার কী ধরনের ঋণ-সংস্কার পদক্ষেপ নিচ্ছেন তার দিকে। খেলাপি ঋণ আদায়ে তাই সরকারের স্বদিচ্ছা থাকবেÑএটা সহজেই অনুমেয়, এই ক্ষেত্রে সহায়ক কিছু নীতিমালা/পরিকল্পনা খেলাপি ঋণ প্রকৃতপক্ষেই কমাতে সহায়ক হবে। 

এক. ঝুঁকিপূর্ণ এবং বৃহৎ ঋণগুলোকে বিমার আওতায় আনা, যেন ব্যবসার যেকোনো দৈব পরিস্থিতিতে কিংবা মালিকের মারা যাওয়ার কারণে ঋণ পরিশোধ নিয়ে পরিবার বা ব্যাংক বিপাকে না পড়ে। ঋণ বিমা নিতে উৎসাহিত করতে ঋণের সুদ কম নেয়া যেতে পারে, কারণ ঋণের ঝুঁকি কমলে ঝুঁকি অধিহার (রিস্ক প্রিমিয়াম) কম আসে।

দুই. ইতোমধ্যে জমির মিউটেশন, খাজনা প্রভৃতি অনলাইনভিত্তিক হয়ে গেছে, যা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। এ ক্ষেত্রে ‘বন্ধকি ব্যাংকের তথ্য’ সন্নিবেশিত করা গেলে সহজেই সম্পত্তি কেনাবেচা বা হস্তান্তরে আগ্রহী ক্রেতা বা বন্ধক নেয়ার আগে ব্যাংক জানতে পারবে যে এই সম্পত্তি কেনা/বন্ধক নেয়া যাবে কিনা। আবার খেলাপি ঋণের তথ্য ভূমি অফিস, ভূমি নিবন্ধন অফিস বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস গ্রহণ করলে সরকারের স্বদিচ্ছায় খেলাপি ঋণগ্রহীতাকে আটকে দেয়া যাবে এবং খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে বাধ্য করা যাবে, যেমনটা করে জমি কেনাবেচায় সরকার প্রথমে ‘করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার’ (ঞওঘ) থাকা এবং এখন আয়কর রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক করেছেন।  

তিন. খেলাপি ঋণের তথ্য জরুরি সেবা প্রতিষ্ঠান যেমনÑ ওয়াসা, ডেসা, ডেসকো, তিতাস প্রভৃতিতে থাকলে সরকার খেলাপি গ্রাহককে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি প্রভৃতির মতো জরুরি সেবা পেতে লোন রেগুলার করার বাধ্যবাধকতা আরোপ করতে পারেন।

চার. খেলাপি ঋণের তথ্য ইমিগ্রেশনে থাকলে এবং ঋণগ্রহীতার জন্য বিদেশ ভ্রমণে ব্যাংক অনাপত্তি সনদ নেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করলে ঋণ আদায় অটোমেটেড প্রক্রিয়ায় সম্ভব। নেপালে খেলাপিরা পাসপোর্টই পান না।

পাঁচ. ভালো গ্রহীতাদের জন্য ‘সুদ অবহার (ঞধী জবনধঃব)’ সুবিধা আরও বিস্তৃতভাবে চালু করে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে।  বিআরপিডি সার্কুলারে (নং ০৬, ১৯  মার্চ ২০১৫) ভালো গ্রহীতাদের (ঙেঙউ ইঙজজঙডঊজ) আদায়কৃত সুদের ওপর ১০ শতাংশ সুদ ফেরত দেয়ার ঘোষণা করা হয়েছিল, যা ব্যাংকগুলো স্বউদ্যেগে করবেন। ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে আমানত-সুদের হার ৬-৯ শতাংশ করার পর এই সুবিধা রহিত করা হয়। এক্ষণে সুদের হার বাড়ানোর কারণে ভালো গ্রহীতাদের মূল্যায়িত করার জন্য এই সুবিধা চালু করা উচিত।

ছয়. ইতোমধ্যে অনেক নেতিবাচকতার মধ্যেই ভোক্তা ঋণের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লোনের মেয়াদগুলো বাড়ানো না হলে ঋণপরিশোধ চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে এবং খেলাপি ঋণ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল থাকবে। বর্তমানে ‘সময় ঋণ’ (ঞরসব খড়ধহ) গুলোর সর্বোচ্চ মেয়াদ ১ বছর, স্বল্পমেয়াদি ঋণগুলোর ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলোর মেয়াদ বাস্তবতার নিরিখে পরিশোধের সুবিধার্থে বাড়ানো যেতে পারে, তবে ঢালাওভাবে করলে ব্যাংকগুলোর টাকা আটকে যাবে ঋণ গ্রহীতাদের কাছে, পুনঃঅর্থায়নের জন্য সংহতি তহবিল (গড়নরষরুধঃরড়হ ঋঁহফ) কমে যাবে।

সাত. প্রতিটি ব্যাংকেই প্রজেক্ট কস্ট এসেস করার জন্য বা কাজের অগ্রগতি নিরূপণের জন্য পুরোকৌশল প্রকৌশলী থাকা জরুরি। কাজের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করেই ধাপে ধাপে ঋণের টাকা ছাড় করা হয়। অতি বিনিয়োগের (ঙাবৎ ঋরহধহপরহম) কারণে ঋণের টাকা সরিয়ে নেয়ার (ঋঁহফ উরাবৎঃ) সুযোগ থাকে, যা আদায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাশাপাশি জমির মূল্যায়নের জন্য ব্যাংকের তালিকাভুক্ত সার্ভেয়ারদের আরও দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। তবে অতিমাত্রায় সংরক্ষণশীল মনোভাব থেকে কম অর্থায়ন (টহফবৎ ঋরহধহপরহম) করলেও প্রজেক্ট ব্যর্থ হতে পারে। শিল্পের গড় বিশ্লেষণ করে ন্যায়সঙ্গত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। 

আট. ঋণ বিতরণের আগে ঋণ গ্রহীতা/গ্রহীতাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সবারই ব্যক্তিগত তথ্য নিতে হবে, যেন যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন স্বামী/স্ত্রীর যোগাযোগ নাম্বার, ই-মেইল, পেশার তথ্য, সন্তানের একাডেমিক তথ্য, নিকটাত্মীয়দের তথ্য, স্থায়ীভাবে বসবাসকারী আত্মীয়দের তথ্য প্রভৃতি। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের অনেক সময়ই ঋণ নেয়ার সময় তার ঘোষিত ঠিকানায় পাওয়া যায় না, ঋণ আদায়ে এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।

নয়.  লোন দেয়ার ক্ষেত্রে এসএমই গ্রাহকদের বিশেষভাবে পরিচর্যা করতে হবে; কারণ অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না এবং নিজেদের ব্যবসার হিসাব ঠিকমতো রাখতে পারেন না। সারাদেশে অঞ্চলভিত্তিক ক্যাম্পেইন করে সেরা ব্যবসায়িক আইডিয়াগুলোতে স্টার্টআপ ফাইন্যান্স করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলো নিজেরা এসব উদ্যোক্তার ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স, ব্যবসায়িক চিঠিপত্র লেখনী, বিপণন কৌশল প্রভৃতির ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়াতে পারেন। ব্যবসা ভালো করলে এবং মনিটরিংয়ে রাখলে ক্ষুদ্র গ্রাহকরা বড় গ্রাহক হলেও ঋণ শিষ্টাচারের প্রতি অনুগত থাকবেন, খেলাপি না হওয়ার চেষ্টা করবেন। 

দশ. গ্রাহকরা ইতোমধ্যে জেনে গেছেন ব্যাংকারদের ঋণ প্রসার ও ঋণ আদায় লক্ষ্যমাত্রা থাকে। অনেক ব্যাংকারের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, কিছু খেলাপি ঋণগ্রহীতা অপেক্ষা করেন বছর শেষে ব্যাংক ক্লোজিংয়ের সময় কীভাবে সুদ মওকুফ আদায় করা যায়। লোন অনুমোদনের সময়ও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাদের ব্যাংকিং নীতিমালার সঙ্গে আপস করার কুইংগিত দেন এই ধরনের গ্রাহকরা। ব্যাংক ব্যবস্থা কেন্দ্রীভূতকরণ (ঈবহঃৎধষরুধঃরড়হ) প্রক্রিয়া এ ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দিলেও অনুমোদন প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন সূচক নির্ধারণপূর্বক স্বয়ংক্রিয় পদ্বতিতে করা গেলে ব্যাংকে এক ধরনের নৈতিক পরিবেশ তৈরি হবে, গ্রাহকরা নিজেরাও ব্যাংকিং শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হবেন। 

এগারো. কোনো ঋণ একদিনেই খারাপ হয় না, তাই ‘সমসাময়িক নিরীক্ষা’ (ঈড়হপঁৎৎবহঃ অঁফরঃ) ব্যবস্থাকে আরও জোরালো করতে হবে, সাপ্তাহিক/পাক্ষিক/বা মাসিকভিত্তিক করা যেতে পারে এবং প্রধান কার্যালয়ে প্রতিবেদন পাঠাতে হবে। একদল দক্ষ, নম্র, ব্যাংকিং আইনের প্রতি অনুগত ব্যাংকারদের মাধ্যমে ঋণ দলিলাদি সম্পন্নকরণ, লোনের জন্য আবশ্যিক কাগজ সংগ্রহ, মজুদকৃত মালামাল যাচাইকরণ, ব্যবসায় বেচাকেনা পর্যবেক্ষণ, রশিদ সংরক্ষণ  প্রভৃতি নিরীক্ষা করানো যেতে পারে।

বারো. অর্থ মামলা নিষ্পত্তিতে এবং দীর্ঘসূত্রতা কমাতে আদালতের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন এবং পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির সময়সীমা বেঁধে দেয়া দরকার। অনেক ঋণখেলাপি ব্যাংকে মহামান্য উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ এনে পুনরায় লোন নেয়ার প্রচেষ্টা চালান, নি¤œ আদালতে মামলার বিচারিক কার্যক্রম শুরু হতেই কয়েক বছর লেগে যায় অনেক ক্ষেত্রে, খেলাপিরা বারবার সময় প্রার্থনা করে বিচারিক প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করেন।

তেরো. মামলা এড়িয়ে ব্যবসায়িক সংগঠন, বণিক সমিতি, মহল্লা উন্নয়ন কমিটি, পঞ্ছায়েত বা ফ্ল্যাট মালিক সমিতি, যেখানে যেটা প্রযোজ্য তাদের সহযোগিতা নিয়ে সামাজিকভাবে খেলাপি ঋণ আদায় ভালো ফল বয়ে আনতে পারে। ইজারা সম্পত্তি বন্ধক রেখে লোন পেতে ঋণ গ্রাহককে বন্ধক অনুমতি জোগাড় করতে হয়। এই ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ যেমনÑরাজউক, গণপূর্ত, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ প্রভৃতিক যতটা দ্রুত বন্ধক অনুমতি দেন, কিন্তু বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রিতে অনেক ক্ষেত্রেই ধীরগতি লক্ষ করা যায়, বছরের পর বছর পার হলেও ফাইল নড়ে না এবং এই ধরনের সম্পত্তি বিক্রিতে কর্তৃপক্ষের অনাপত্তি পেতে লাখ টাকার ডিমান্ড থাকে বলে জানা যায়।

চৌদ্দ. কিছু ক্ষেত্রে, ঋণগ্রহীতার মৃত্যুর কারণে বা করোনা/অনিয়ন্ত্রণাধীন কারণে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া/ হঠাৎ বিদেশি গ্রাহক হারানোর (লেদার ওয়ারকিং গ্রুপ সম্মতি সনদ না থাকার কারণে ট্যানারি ব্যবসায়ীরা এ ধরনের সমস্যায় পড়েছেন) মতো ইস্যু থাকে। এসব ক্ষেত্রে বিক্রয় প্রাপ্যগুলো আদায় করে কিংবা বন্ধকি/স্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংক লোন সমন্বয়ের উদ্যোগ নিতে হয় গ্রাহককে বা বন্ধকি ব্যাংককে। পুনঃতফসিলের সর্বশেষ মাস্টার সার্কুলার অনুযায়ী, গ্রেস পিরিয়ডসহ দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে পরিশোধের সুবিধা থাকলেও পুনঃতফসিলের শর্তাবলি অনুযায়ী তারল্য বিবরণী, আয়-ব্যয় বিবরণী, মজুত মালামালের বিবরণী প্রভৃতি প্রদান তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় না। কারণ ব্যবসা চলমান নেই। গতানুগতিক ধারায় কোনোভাবে পুনঃতফসিল করলেও নিয়মিত কিস্তি দিতে না পারার কারণে আবারও খেলাপি হয়ে যায়; কারণ তার ঋণ পরিশোধ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়ে পরিশোধ হওয়ার কথা। এই ধরনের খেলাপি গ্রাহকদের চলমান ঋণ সীমা/স্থিতি পরিশোধের সুবিধার্থে খেলাপি চিহ্নিত না করে ২-৪ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ‘সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে নবায়ন’ করা গেলে এবং গ্রাহককে বাস্তবতার নিরিখে কিছু এলসি/গ্যারান্টি সুবিধা দেয়া গেলে তারা ব্যবসাটা চালু রাখার চেষ্টা করতে পারেন। স্বতঃসিদ্ধ প্রথা হলো, ব্যবসা কোথাও আটকে গেলে মার্কেট থেকে ধারে পণ্য বিক্রির টাকা আর আদায় হয় না, এমনকি ডিলার বা রিটেইলারদের থেকেও সহযোগিতা পাওয়া যায় না। ফলে ব্যবসায়ীর সংকট আরও প্রবল হয়। অন্যদিকে ঋণ আদায়ের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ‘অঙ্কের হিসাবে’ গ্রাহককে খেলাপি করার কারণে কারণে ব্যাংকের বাড়তি প্রভিশন রাখতে হয় এবং ব্যাংকের অংশীজনদের কাছে অস্পষ্ট বার্তা যায়, যার প্রভাব মানি মার্কেট, ক্যাপিটাল মার্কেট সর্বত্র। এই ধরনের খেলাপি গ্রাহকদের জন্য বিশেষ কোনো নামে সিআইবি রিপোর্টিং করা যেতে পারে যেন অন্য ব্যাংক সহজেই তার স্ট্যাটাস বুঝতে পারে।

পনেরো. বিগত কয়েক বছরে সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাংকগুলো সরকারি কার্যাদেশের বিপরীতে  বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে কাজ করে আসছে। ডলার সংকট, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধি সব এক সুতায় জড়িয়ে গেছে; ফলে প্রজেক্টের প্রকৃত ব্যয় অনুমোদিত ব্যয় বাজেটকে ছাড়িয়ে গেছে। এমতাবস্থায় মূল্য সমন্বয়পূর্বক প্রজেক্টের বাজেট পুনর্নির্ধারণ না করলে ঠিকাদাররা ক্ষতির সম্মুখীন হবে/হচ্ছে এবং পরিনামে ব্যাংক ঋণগুলো খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পরিচালন পর্ষদকে সব ক্ষমতা অর্পণ করে ভারমুক্ত হয়েছেন। বিগত কয়েক বছরে মানুষ করোনা, যুদ্ধ, বন্যা, মহামারি সবই দেখেছে, যা দূর অতীতেও দেখা যায় না। সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক সাধারণ শ্রমিকের মাসিক বেতন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে পৌঁছানোসহ ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যবসাবান্ধব অনেক প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়েছেন এবং ঋণ পরিশোধ অবকাশ সুবিধা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অভিভাবকের আসনে বসে যেই সাহসিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্বশীলতা দেখিয়েছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সেই ধরনের কিছু উদ্যোগ/সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক পাশে থাকবে এই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সবারই।

এভিপি ও ম্যানেজার (অপারেশন)

এনআরবিসি ব্যাংক লিমিটেড

[email protected]