এম এ খালেক: ২০১৬ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন দুই অর্থনীতিবিদ অলিভার হার্ট ও বেংট হমস্ট্রোন। তারা দুজনই মার্কিনি যদিও অলিভার হার্টের জন্মস্থান ব্রিটেন ও বেংট হমস্ট্রোনের জন্ম ফিনল্যান্ডে। সুইডেনের স্টকহোমে রয়্যাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণার আগ পর্যন্ত এ দুজনের কেউই বুঝতে পারেননি, তারা নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন বা পেতে পারেন। কারণ তারা যে বিষয়ে গবেষণা করেছেন, তা বেশ অভিনব। আগে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনাও হয়নি। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, এ দুই অর্থনীতিবিদের আরও আগেই নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত ছিল। তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ‘চুক্তিতত্ত¡’। নোবেল কমিটি বলেছে, এ দুজন গবেষকের কাজ শীর্ষ নির্বাহী পদে আসীনদের কর্মদক্ষতার ওপর বেতন-ভাতা নির্ধারণের বিষয়টি বুঝতে সহায়তা করবে। আধুনিক সমাজের স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপের জন্য এ চুক্তি অপরিহার্য। কমিটি আরও বলেছে, সমাজে নানা ধরনের চুক্তি হয়। শেয়ার মালিক ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের মধ্যে চুক্তি হয়। আবার বিমা কোম্পানির সঙ্গে গাড়িমালিকের চুক্তি হয়। এসব চুক্তি খুবই জটিল ও তা এমনভাবে সম্পাদন করা প্রয়োজনÑযাতে উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষিত হয়। বেংট হমস্ট্রোন গবেষণা করেছেন উচ্চপদে কর্মরতদের নিয়োগসংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে। অন্যদিকে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় থাকা উচিত, নাকি এগুলোকে ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া উচিত তা নিয়ে গবেষণা করেছেন অলিভার হার্ট। বেংট হমস্ট্রোন ১৯৭০ সাল থেকে চুক্তিতত্ত¡ নিয়ে কাজ করছেন। তার অভিমত একটি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা অবশ্যই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির কর্মদক্ষতার ওপর নির্ধারণ করা উচিত। অন্যথায় অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিটি হতাশ হতে পারেন। এতে তার কর্মদক্ষতা ও কর্মকুশলতা হ্রাস পেতে পারে। তিনি আরও দেখাতে চেয়েছেন, একজন কর্মীকে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধি নাকি পদোন্নতিÑকোনটি বেশি কার্যকর। অলিভার হার্ট মনে করেন, যখন একটি চুক্তি করা হয়, তখন সে চুক্তির বাস্তবতা পুরোপুরি অনুধাবন সম্ভব হয় না। আগামী দিন সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়, তাও সব সময় সঠিকভাবে কাজ করে না। সুতরাং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, চুক্তি করার পর পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো কীভাবে নিতে হবে।
বেংট হমস্ট্রোন ও অলিভার হার্ট উভয়েই অধ্যাপক। তাদের এ গবেষণার বিষয়টি অভিনব এতে সন্দেহ নেই। উন্নত দেশগুলোয় কর্মীর কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতাকে বেতন-ভাতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিবেচনায় রাখা হলেও উন্নয়নশীল দেশে তা বরাবরই উপেক্ষিত। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় প্রচলিত ব্যবস্থায় বেতন-ভাতা নির্ধারণে কর্মীর র্যাংক বা পদবিকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, তার উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতাকে ততটা বিবেচনায় রাখা হয় না। একই র্যাংকে কর্মরত বলে অধিকতর যোগ্য ব্যক্তিও কম যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তির সমপরিমাণ আর্থিক সুবিধাদি পেতে পারেন। ধরা যাক, রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত দুটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাতীয় বেতন কাঠামোয় একই ধাপে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন ৮০ হাজার টাকা (নির্ধারিত) বেতন পাচ্ছেন। এ দুই ব্যাংকের শীর্ষ পদে যে দুজন নিয়োগ পাবেন, তাদের কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা ও উৎপাদনশীলতা যে একই হবে, সে নিশ্চয়তা কি দেওয়া যায়? একজন অন্যজনের চেয়ে দক্ষ ও প্রতিভাবান হতেই পারেন। কিন্তু তারা একই স্কেলে বেতন পেলে অধিকতর দক্ষ ব্যক্তির প্রতি কি অবিচার করা হবে না? নিয়মিত পদে ও চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে নিয়োজিতদের মাঝেও বেতন-ভাতা নিয়ে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। একটি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের নিয়মিত চাকরিরত শীর্ষ নির্বাহী কর্মকর্তার মাসিক মূল বেতন হয়তো ৮০ হাজার টাকা; কিন্তু দেখা যায় একই পদে কোনো ব্যক্তি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত হলে তার মাসিক বেতন হয় তিন বা চার লাখ টাকা। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত চাকরিরত ও চুক্তিভিত্তিক ব্যক্তির বেতন কাঠামোয় বৈষম্য সৃষ্টি হয়। নিয়মিত চাকরিরত একজন ডিএমডির মাসিক মূল বেতন যদি হয় ৭০ হাজার টাকা এবং তার এক ধাপ ওপরে অবস্থানকারী চুক্তিভিত্তিক এমডির বেতন যদি হয় তিন বা চার লাখ টাকা, তাহলে এ দুই ব্যক্তির মধ্যে মানসিক দ্বদ্ব সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ঠিক সেটিই হচ্ছে। এমনও দেখা গেছে, এক ব্যক্তি হয়তো নিয়মিত চাকরিকালীন মাসিক বেতন পেতেন ৬০ হাজার টাকা। চাকরি থেকে অবসরের পরদিন একই প্রতিষ্ঠানে তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োজিত হলেন এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। প্রশ্ন হলো অবসর নেওয়ার মাত্র একদিনের ব্যবধানে বর্ণিত ব্যক্তির কী এমন যোগ্যতা বৃদ্ধি পেল যে, রাতারাতি তার বেতন দ্বিগুণ হলো? অনেক প্রতিষ্ঠানেই চুক্তিভিত্তিক চাকরিতে নিয়োগের বিধান রয়েছে। এসব পদে বাইরে থেকে জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। অনেক সময় একই প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিও নানাভাবে তদবির করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ লাভ করে থাকেন। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্তি এখন খুবই লাভজনক বিষয়।
বাংলাদেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় বেতন কাঠামো নির্ধারণে উৎপাদনশীলতাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত কর্মীকে একই পাল্লায় পরিমাপ করা হয়। সমপদে কর্মরত দুই কর্মীর বেতন দেওয়া হয় একই হারে। পদোন্নতির ক্ষেত্রে আরও বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। একই র্যাংকে কর্মরত দুই কর্মীর মধ্যে যিনি অপেক্ষাকৃত সিনিয়র, তারই আগে পদোন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যদিও তার চেয়ে তুলনামূলক জুনিয়র কর্মীর কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা হয়তো বেশি। এ-ছাড়া দেশের প্রচলিত ব্যবস্থায় যেভাবে কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়, সেটাও কতটা যৌক্তিকÑতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপনের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে একজন কর্মী চাকরিতে প্রবেশ করতে পারলে অবশিষ্ট কর্মজীবন তিনি সে প্রতিষ্ঠানেই কাটিয়ে দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বা কর্মীর কর্মদক্ষতা কোনো বিবেচনায় আনা হয় না। সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে একবার চাকরিতে প্রবেশ করতে পারলে আর চাকরি খোয়ানোর ভয় নেই। যদিও এটা ঠিক নয়। কারণ কোনো বড় ধরনের অপরাধ বা অন্যায় করলে যে কোনো ব্যক্তির চাকরি চলে যেতে পারে; কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার অভাব বা দুর্নীতির কারণে কারও চাকরি চলে যায় না। বরং কেউ যদি সৎ হন ও সর্বোচ্চ স্বচ্ছতার মাধ্যমে চাকরি করতে চান, তার চাকরি চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে! দুর্নীতিবাজরা খুবই সংঘবদ্ধ। তারা যে কোনো অন্যায়-অপকর্ম থেকে নিজেদের বাঁচাতে সক্ষম। উন্নত অনেক দেশেও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। চুক্তিকালীন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কর্মদক্ষতা সন্তোষজনক হলে মেয়াদ বাড়ানো হয়। সন্তোষজনক না হলে চুক্তি শেষে বা চুক্তি শেষ হওয়ার আগেও বিদায় করে দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক পরিসরে দুর্নীতির প্রধান কারণ হলো, এখানে অন্যায় করলেও চাকরি যাওয়ার ভয় নেই। মানুষ এখন চাকরিকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাই কেউই ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাকরিচ্যুত হতে চান না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় প্রতিনিধির মাধ্যমে। রাষ্ট্র কখনই কোনো প্রতিষ্ঠান নিজে পরিচালনা করে না। রাষ্ট্র প্রতিনিধির মাধ্যমে তার আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে; ফলে সেখানে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা থাকে সর্বনি¤œ পর্যায়ে। কিন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় মালিকের অধীনে। সেখানে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা থাকে উচ্চমাত্রায়। কর্মীর পক্ষে সেখানে দুর্নীতি করে পার পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি থাকে সবচেয়ে বেশি। কারণ মানুষ সেবা গ্রহণের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে আসে। মনোপলি বিজনেসের অধিকার সাধারণত কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া উচিত নয়। কারণ অধিকসংখ্যক মানুষ বা সেবাগ্রহীতা যদি সীমিত সুবিধার দিকে ধাবিত হয় সেখানে দুর্নীতি হবেই। তাই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানকে যথাসম্ভব ব্যক্তিমালিকানায় হস্তান্তর প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো যদি ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া সম্ভব না হয়, তাহলে ব্যক্তি খাতকে একই ধরনের প্রতিষ্ঠান স্থাপনের অনুমতি দেওয়া উচিত। উদাহরণস্বরূপ, ৯০ দশকের আগে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ছিল না। তখন আমাদের টিঅ্যান্ডটি ডিপার্টমেন্টের (বর্তমানে বিটিসিএল) ওপর নির্ভর করতে হতো। একটি টেলিফোন সংযোগ পেতে সেটের মূল্যসহ ২০ হাজার টাকা দিতে হতো তখন। অবৈধ অর্থ ব্যয় ছাড়া টেলিফোন সংযোগ পাওয়া ছিল যুদ্ধ জয়ের মতোই কঠিন। আবার ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দেওয়ার পরও প্রায় এক বছর অপেক্ষা করতে হতো। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা। এখন দেশে বেশ কয়েকটি বেসরকারি অপারেটরের কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় সবার হাতে মোবাইল ফোন। টিঅ্যান্ডটি ফোনের চাহিদা এখন অনেক কমে গেছে। ইতোমধ্যেই ল্যান্ডফোনের সংযোগ চার্জ অনেকটাই কমানো হয়েছে; তারপরও সাধারণ মানুষ ল্যান্ডফোন কেনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে না। যে খাতে দুর্নীতি হয়, সেখানেই সমজাতীয় একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে দুর্নীতি করলে তেমন কোনো বিচার হয় না; সেখানে কোনোভাবেই মনোপলি বিজনেস চলতে দেওয়া যায় না।
মনোপলি বিজনেস মানুষের সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশে সহায়ক নয়। একইভাবে যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মীর বেতন-ভাতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে তার দক্ষতা, সততা ও উৎপাদনশীলতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। একজন প্রকৌশলী ও সাধারণ কর্মী একই র্যাংকে চাকরি করায় যদি তাদের সমহারে বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তাহলে যিনি উচ্চমাত্রায় উৎপাদনশীলতার দাবিদার, তার মাঝে হতাশা আসতে বাধ্য। আর কে না জানে একজন হতাশ ব্যক্তির কাছ থেকে কখনই ভালো কিছু আশা করা যায় না। অবাধ্য ছাগলকে বলপূর্বক পানিতে নামানো যেতে পারে; কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটিকে কখনই পানি পান করানো যাবে না।
অর্থনীতিবিষয়ক কলাম লেখক