শেখ শাফায়াত হোসেন : রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে রতবদল ঘটেছে। এর মধ্যে দিয়ে আগের অনেক প্রকল্প বাতিল হয়ে যাচ্ছে। অনেক প্রকল্প আটকে থাকছে। আবার কোনো কোনো প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) একটি প্রকল্পে এমন কিছু অসঙ্গতির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। অভিযোগে বলা হয়, এক ধাক্কায় প্রকল্প ব্যয় ১১২ কোটি টাকা বেড়ে যাচ্ছে। এই বাড়তি অর্থ বাপেক্সের কতিপয় কর্মকর্তার পকেটে ঢুকবে।
জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের দ্বীপ জেলা ভোলায় বাপেক্সের পাঁচটি কূপ খননের লক্ষ্যে ৮৪০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ একটি স্বনামধন্য আন্তর্জাতিক তেল ও গ্যাস কোম্পানি তাদের নিজস্ব ড্রিলিং রিগ ভাড়া এবং কারিগরি সহায়তা প্রদান করে যৌথভাবে বাপেক্সের সঙ্গে এই কূপগুলো খননের প্রস্তাব দিয়েছিল, যার সম্ভাব্য ব্যয় হতো মাত্র ৭২৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এই প্রস্তাব গ্রহণ করলে একদিকে যেমন ১১২ কোটি ৫৭ লাখ টাকার বিশাল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো, অন্যদিকে প্রায় এক বছর সময়ও বাঁচানো সম্ভব হতো। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে কাজের সুযোগ পাওয়া গেলে বাপেক্সের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাও বাড়ত, যা ভবিষ্যতের খনন কার্যক্রমে ইতিবাচক প্রভাব ফেলত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব সম্ভাবনা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠানটি নানা প্রশ্ন ও বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে।
অভিযোগ পাওয়া যায়, বাপেক্সের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (বর্তমানে পেট্রোবাংলার পরিচালক) মো. শোয়েব ওই আন্তর্জাতিক কোম্পানির প্রস্তাব উপেক্ষা করেন এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে এবং পিপিআর অনুসরণ না করেই একটি ব্যয়বহুল দরপত্র প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন।
তবে এ বিষয়ে মো. শোয়েব গতকাল শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি থাকাকালে একটি ওপেন টেন্ডারে ওই পাঁচটি কূপ খননের দরপত্র আহ্বান করা হয়। এখন আমি আর বাপেক্সে নেই। সেখানে যারা দায়িত্বে আছেন তারা কীভাবে টেন্ডার করছেন তা আমার জানা নেই।’
বাপেক্সের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফজলুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনকলে সাড়া দেননি।
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে গ্যাস উৎপাদন কমে আসছে। ঘাটতি মেটাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি বাড়িয়েও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি েেকই যাচ্ছে। এই সংকট নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকার দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে কূপ খননে জোর দিয়েছে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় জারি করা এক অফিস আশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, জ্বালানি ও খনিজ সম্প বিভাগের আওতাধীন প্রকল্পের ডিপিপি অনুমোদনের আগে সংশ্লিষ্ট কোনো সংস্থা যেন প্রকল্প সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রম গ্রহণ না করে, তা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ, এই আদেশ অমান্য করেই দরপত্র কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বাপেক্স।
এর আগে সিলেট-১০ নামক একটি কূপে জিটিও অনুযায়ী ড্রিলিং টার্গেট ডেপথ ছিল ৩৩০০ মিটার, কিন্তু ড্রিল পাইপ আটকে যাওয়ার কারণে মাত্র ২৫৭৬ মিটার পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয়। উচ্চচাপের কারণে ড্রিল পাইপ স্টাক করে এবং কাক্সিক্ষত স্তরে পৌঁছানো যায়নি, ফলে বিপুল গ্যাস মজুত থাকার পরও উত্তোলন সম্ভব হয়নি। সেই র্ব্যতার পর একই স্থানে ‘১০-এক্স’ নামে আরেকটি নতুন কূপ খননের পরিকল্পনা নেয়া হয়, যার মাধ্যমে দেশের বিপুল অর্থ অপচয় হচ্ছে। অথচ এই প্রকল্পের দরপত্রে সর্বনি¤œ দরদাতা কোম্পানিটি অতীতেও সিলেট অঞ্চলে ড্রিলিং কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়েছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম সম্ভাবনাময় গ্যাস অঞ্চল ভোলা। এ পর্যন্ত ভোলায় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে, যা একটি জেলার মধ্যে সর্বোচ্চ। ভোলার ক্ষিণাঞ্চল যেমন চরফ্যাশন, হাতিয়া, মনপুরা অঞ্চলগুলোয়ও গ্যাসের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। একাধিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ভোলা ও এর আশপাশের অঞ্চলে আনুমানিক ৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস মজুত রয়েছে, যা দেশের বিদ্যমান গ্যাস সংকট নিরসনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আশঙ্কার বিষয় হলো, ভোলায় ভূগর্ভস্থ চাপ সিলেটের তুলনায় অনেক বেশি। পূর্ব অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও একই ড্রিলিং রিগ ও অনভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে এই উচ্চচাপ অঞ্চলে কূপ খননের উদ্যোগ একটি ঝুঁকিপূর্ণ ও অর্থনৈতিকভাবে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

Discussion about this post