তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল : ২০২৫ সালের ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় স্কুলের ওপর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ৩২টি প্রাণের ঝরে পড়া এবং তার কয়েক বছর আগে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় রাসায়নিক দ্রব্যের আগুনে অঙ্গার হওয়া ৭০টির বেশি জীবন্ত শরীর—এই দুটি ঘটনা কেবল দুর্ঘটনা নয়, এগুলো আমাদের রাষ্ট্রীয় অক্ষমতার একেকটি রক্তাক্ত স্মারক। প্রতিটি বিপর্যয়ের পর যখন স্বজনহারাদের আর্তনাদ আর পোড়া লাশের গন্ধ বাতাসে মেশে, তখন একটি প্রশ্নই আমাদের বিবেককে দংশন করে—কেন পরিচয় শনাক্ত করার মতো একটি মৌলিক মানবিক প্রক্রিয়া আমাদের দেশে এতটা জটিল, বেদনাদায়ক ও অমানবিক? উত্তরার স্কুলপ্রাঙ্গণ বা চুড়িহাট্টার গলি—দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপট হলেও ফলাফল এক ও অভিন্ন। এই বিপর্যয়গুলো প্রমাণ করে, নাগরিকের পরিচয় নিশ্চিত করার যে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, তা কতটা ঠুনকো, অসম্পূর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল।
এই জটিলতার বহুবিধ কারণ রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, প্রথমত, দুর্ঘটনার ভয়াবহতা, যেক্ষেত্রে আগুনের তীব্রতায় মরদেহ এমনভাবে বিকৃত হয় যে, বাহ্যিক শনাক্তকরণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ডিএনএ পরীক্ষাই হয় একমাত্র ভরসা, যা সময়সাপেক্ষ এবং শোকাহত পরিবারের জন্য এক অন্তহীন যন্ত্রণা। দ্বিতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ কারণটি হলো, আমাদের পরিচয়পত্রে জীবনরক্ষাকারী তথ্যের অনুপস্থিতি। যে পরিচয়পত্রটি জরুরি মুহূর্তে একজন মানুষের জীবন বাঁচাতে পারত, সেটি এখন কেবল নাম-ঠিকানার একটি নির্জীব দলিলে পরিণত হয়েছে! তৃতীয়ত, নিহতদের সামাজিক অবস্থান। চকবাজারের নিহত ব্যক্তিদের বড় অংশই ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ, যাদের অনেকেরই হয়তো হালনাগাদ পরিচয়পত্র ছিল না। এই সম্মিলিত ব্যর্থতার কারণেই প্রতিটি দুর্ঘটনার পর আমাদের কেবল বেওয়ারিশ লাশের মিছিল গুনতে হয়।
প্রচলিত পরিচয়পত্র: তথ্যগত ত্রুটি ও তার ভয়াবহ পরিণতি
পরিচয়পত্র একটি রাষ্ট্রের তার নাগরিককে দেয়া স্বীকৃতির প্রধান ও অন্যতম দলিল। এটি কেবল একটি প্লাস্টিক বা কাগজের টুকরো নয়, বরং নাগরিক অধিকার, সেবা ও নিরাপত্তার প্রতীক। বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর সর্বজনীন রূপ পায় মূলত ছবিসহ ভোটার তালিকা এবং তার ভিত্তিতে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) প্রদানের মাধ্যমে। কিন্তু এর পরিকল্পনায় মধ্যেই ছিল এক মৌলিক সীমাবদ্ধতা! যেমন প্রাথমিকভাবে এনআইডির উদ্দেশ্য ছিল কয়েকটি প্রশাসনিক কাজে সীমাবদ্ধ ভোট প্রদান, ব্যাংক হিসাব খোলা বা জমি রেজিস্ট্রেশনের মতো কাজে পরিচয় যাচাই করার ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ এটি তৈরি হয়েছিল একটি প্রশাসনিক হাতিয়ার হিসেবে, জরুরি অবস্থার ব্যবস্থাপনার জন্য নয়!
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়ণের ফলে দুর্ঘটনা এবং জরুরি পরিস্থিতির আনুপাতিক হার বেড়েছে। এখন পরিচয়পত্রের ভূমিকা কেবল প্রশাসনিক কাজে সীমাবদ্ধ নেই, এটি নাগরিক সুরক্ষার এক অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থাটি এই পরিবর্তিত বাস্তবতার সঙ্গে তাল মেলাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এর প্রধানতম দুর্বলতা হলো এর খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ তথ্য, যার ফাঁকফোকরগুলো জীবন-মরণ সমস্যা তৈরি করছে।
প্রথমত, তথ্যের অপর্যাপ্ততা। আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে জরুরি স্বাস্থ্য বা যোগাযোগের কোনো তথ্যই নেই। জরুরি যোগাযোগের নম্বর, ক্রনিক ডিজিজ বা মারাত্মক অ্যালার্জির তথ্য—এ সবকিছুই এর আওতার বাইরে। দ্বিতীয়ত, সমন্বয়হীনতা। জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স—এ দলিলগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বিত তথ্যভান্ডার বা আন্তঃসংযোগ নেই। একটিতে তথ্য হালনাগাদ হলে অন্যটিতে তা প্রতিফলিত হয় না।
এই ফাঁকফোকরের ফলে সৃষ্ট জটিলতাগুলো ভয়াবহ। চিকিৎসায় বিলম্ব ও ঝুঁকি একটি বড় উদ্বেগের কারণ। এনআইডি বা ড্রাইভিং লাইসেন্সে রক্তের গ্রুপ লেখার বিধান থাকলেও সেই তথ্যটি প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার রিপোর্টের ভিত্তিতে লেখা হয়, নাকি শুধু ব্যক্তির মুখের কথার ওপর নির্ভর করা হয়, তা নিয়ে গুরুতর সংশয় রয়েছে। যাচাইবিহীন ভুল তথ্যের ওপর নির্ভর করে রক্ত সঞ্চালন রোগীর জীবনকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অন্যদিকে জরুরি যোগাযোগের নম্বর না থাকায় পরিবারগুলো দুর্ঘটনার খবর পায় না, যা তাদের অবর্ণনীয় ভোগান্তির কারণ হয়।
পরিচয়পত্র নিয়ে নির্দেশনা: মৃত্যুর পরই কেন টনক নড়ে?
আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা হলো, আমরা সমাধান খুঁজি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নয়। উত্তরার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর যখন ছাত্রছাত্রীদের আইডি কার্ডে রক্তের গ্রুপ বা অভিভাবকের নম্বর না থাকার বিষয়টি আলোচনায় আসে, তখন মহামান্য হাইকোর্ট একটি স্বতঃপ্রণোদিত নির্দেশনা জারি করেন। এই নির্দেশনায় শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ডে এই জরুরি তথ্যগুলো যুক্ত করা বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, কিন্তু এটি একটি খণ্ডিত ও প্রতিক্রিয়াশীল সমাধান। এটি কেবল ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য এবং জাতীয় পরিচয়পত্রের মূল সমস্যাটিকে এটি স্পর্শ করে না।
চকবাজারের ঘটনার পরও বিশেষজ্ঞরা একটি সমন্বিত পরিচয়পত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেই আলোচনাগুলো কখনোই একটি সুনির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় নীতিমালায় রূপান্তরিত হয়নি। এই ‘ঘটনার পর সমাধান খোঁজা’র সংস্কৃতি আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং আমলাতান্ত্রিক দূরদৃষ্টিহীনতা। একটি সমন্বিত ব্যবস্থা তৈরির জন্য যে প্রাথমিক বিনিয়োগের প্রয়োজন, তাকে একটি কম জরুরি প্রকল্প হিসেবে দেখার মানসিকতাও এর জন্য দায়ী।
সমন্বিত ডিজিটাল পরিচয়পত্র: সংস্কারের পথে চূড়ান্ত সমাধান
জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান কেবল একটি রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ছিল না, এটি ছিল বহু বছর ধরে জমে থাকা অনিয়ম ও নাগরিক অবহেলার বিরুদ্ধে একটি নতুন আকাঙ্ক্ষার জাগরণ। এই সংস্কারের চেতনাই আমাদের সুযোগ করে দিয়েছে পরিচয়পত্রের মতো একটি মৌলিক বিষয়কে নতুন করে ঢেলে সাজানোর। এখন আর খণ্ডিত বা প্রতিক্রিয়াশীল সমাধান নয়, প্রয়োজন একটি বৈপ্লবিক এবং স্থায়ী পদক্ষেপ। সেই পদক্ষেপটি হলো ‘সমন্বিত ডিজিটাল নাগরিক পরিচয়পত্র’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
এই ব্যবস্থার কয়েকটি মূল ভিত্তি থাকবে:
্ক বাধ্যতামূলক জরুরি তথ্য: প্রত্যেক নাগরিকের জন্য রক্তের গ্রুপ, অন্তত দুজন জরুরি সাহায্যকারীর নাম ও নম্বর, দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং মারাত্মক অ্যালার্জির তথ্য এই পরিচয়পত্রের ডিজিটাল তথ্যভান্ডারে সংযুক্ত করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
- প্রযুক্তিগত সমন্বয়: এটি হবে একটি স্মার্ট কার্ড, যাতে একটি কিউআর কোড থাকবে। অনুমোদিত ব্যক্তি (যেমন চিকিৎসক, পুলিশ, উদ্ধারকর্মী) একটি বিশেষ অ্যাপের মাধ্যমে সেই কোড স্ক্যান করে মুহূর্তেই জরুরি তথ্যগুলো পেয়ে যাবেন।
- কেন্দ্রীয় ও সুরক্ষিত তথ্যভান্ডার: দেশের সব নাগরিকের সব ধরনের তথ্য একটি সুরক্ষিত কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত থাকবে এবং এর গোপনীয়তা কঠোর আইন দ্বারা সুরক্ষিত হবে।
- সর্বজনীন আইনি কাঠামো: একটি নতুন আইন প্রণয়ন করে শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবার জন্য এই সমন্বিত পরিচয়পত্রকে দেশের একমাত্র আইনগত পরিচয় দলিল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
চকবাজারের পুড়ে যাওয়া লাশ বা উত্তরার আহত শিশুর আর্তনাদ আমাদের কাঁধে যে দায় চাপিয়ে দিয়েছে, তা কেবল শোক প্রকাশ করে শোধ করা সম্ভব নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের পরের এই নতুন বাংলাদেশে সেই দায় শোধ করার একমাত্র পথ হলো একটি আধুনিক, মানবিক ও জীবনরক্ষাকারী পরিচয় ব্যবস্থা তৈরি করা, যেন ভবিষ্যতে আর কোনো পরিবারকে পরিচয়হীনতার যন্ত্রণায় ভুগতে না হয়।
মানবসম্পদ প্রশিক্ষক

Discussion about this post