আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : রাজশাহীর খরাপ্রবণ বরেন্দ্র এলাকায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পদ্মা নদী থেকে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পানি উত্তোলন করে সেচ সরবরাহে এক বড় প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটির তত্ত্বাবধান করছে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ)। ‘রাজশাহী বরেন্দ্র সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে পরিচিত এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪৮ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২২ থেকে ২০২৭ সাল।
প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদী থেকে দুই ধাপে পানি উত্তোলন করে তা বরেন্দ্র অঞ্চলের উঁচু জমিতে সরবরাহের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম ধাপে নদী থেকে পানি তুলে একটি সংরক্ষণ ট্যাংকে উঠিয়ে রাখা হবে, দ্বিতীয় ধাপে সেই পানি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পের সাহায্যে জমিতে পৌঁছানো হবে।
বিএমডিএর ওয়েবসাইট ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রকল্পের বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ। যদিও বাজেটভিত্তিক অর্থায়নের হিসাবে খরচ হয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। আর কাজ হয়েছে ২০ শতাংশ!
স্থানীয় কৃষক ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র অভিযোগ করেছেন, প্রকল্পে ব্যবহƒত পাইপ ও যন্ত্রপাতির মান অত্যন্ত নি¤œমানের, নির্মাণকাজে ঢিলেঢালা মনোভাব রয়েছে, অনেক জায়গায় পাইপলাইন বসানো হয়নি এবং বেশ কিছু ঠিকাদার বিল তুলেছেন কাজ না করেই।
গোদাগাড়ী উপজেলার কৃষক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘পাইপ বসানো হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পানি আসছে না। পানি না পেলে আমরা আবারও নলকূপের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কৃষক রাজিব হোসেন জানান, তিন বছর হয়ে গেল, এখনও আমাদের জমিতে পানি পৌঁছায়নি। খালি আশা দিয়েই যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্পের মাধ্যমে বরেন্দ্রর কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব। কিন্তু দুর্নীতি ও পরিকল্পনার অভাবে তা বাস্তবায়ন না হলে এটি কাগুজে স্বপ্নেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
বিএমডিএর এক অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত প্রকল্পে অন্তত ৮৬৪ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য কাজ শুরু হলেও সেচ সরবরাহ সম্পূর্ণ হয়নি। ঐউচঊ পাইপলাইনের স্থায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অনেক পাইপলাইন ফাটল ধরেছে বলে জানা গেছে। এছাড়া রিজার্ভার নির্মাণের কাজও এখনো শেষ হয়নি। (সূত্র: নসফধ.মড়া.নফ)
অনুসন্ধানে জানা, প্রকল্পের আওতায় একটি ২৯ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল, চারটি সোলার খখচ এবং ৩৬টি পানির সংযোগ স্থাপন করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পানি পৌঁছাচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় প্রকল্পে অতীতেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, যেমন- পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাহারের ঘটনা। সেই উদাহরণ টেনে অনেকে বলছেন, যথাযথ তদারকি না থাকলে এই প্রকল্পও দুর্নীতির চোরাবালিতে ডুবে যেতে পারে।
বিএমডিএর প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অনেক জায়গায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত সমাধান করার। তিনি জানান, ২০২৬ সালের মধ্যেই পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হচ্ছে।’
অন্যদিকে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে চলতি বোরো মৌসুম থেকে কার্যকর করা হয়েছে নতুন সেচ নীতিমালা। ফলে এর প্রভাব পড়েছে চাষাবাদে। পানি সংকটে চাষাবাদ করা সম্ভব হয়নি ১০ হাজার হেক্টরের ওপর জমি। এ কারণে কমছে ধান উৎপাদন। তবে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জন্য আশার আলো দেখাচ্ছে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রসারণ (ইআইডিএল) প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় পদ্মা নদী থেকে (সাড়ে ১৮ কিলোমিটার দূর থেকে) পানি এনে প্রায় ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেয়ার যে উদ্যোগ, এতে উপকৃত হবেন অন্তত ৩০ হাজার কৃষক। তবে শেষ হয়েছে প্রকল্পের মাত্র ২০ শতাংশ কাজ। ২০২৭ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
রাজশাহী কৃষি সম্প্র্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ মিলে রাজশাহী বিভাগের কৃষি অঞ্চল। এই অঞ্চলগুলোতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭৫ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমি।
তবে গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮৬৫ হেক্টর জমিতে বেশি বোরো চাষ হয়। সব মিলিয়ে গত বছর ধান চাষ হয় তিন লাখ ৭৬ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। তবে চলতি (২০২৪-২০২৫) অর্থবছর ধান চাষ কমেছে। এ বছর ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ৭৬ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে। তবে পানি সংকটের কারণে চাষ হয়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। ফলে গত বছরের চেয়ে এবার চাষ কমেছে ১০ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে রাজশাহী জেলায় কমেছে এক হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে। নওগাঁয় কমেছে ৫৪০ হেক্টর, নাটোরে তিন হাজার ৫০০ হেক্টর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে চার হাজার ২০৫ হেক্টর।
বিএমডিএ তথ্য বলছে, পানি সংকটে থাকা আট উপজেলায় সংস্থাটির মোট তিন হাজার ৫৮৮টি সচল গভীর নলকূপ রয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯৬০টি নলকূপ তীব্র পানি সংকটপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত। ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের প্রাপ্যতার ওপর ভিত্তি করে প্রতিটি নলকূপ ২৪ হেক্টর থেকে ৪০ হেক্টর জমিতে পানি সেচ সরবরাহ করতে পারে।
বিএমডিএর নতুন নীতিমালা অনুযায়ী, ভূগর্ভস্থ পানিরস্তর স্থিতিশীল রাখতে বছরে একটি গভীর নলকূপ মোট ১ হাজার ৯৬০ ঘণ্টা চালানো হবে। এর মধ্যে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৫ মে পর্যন্ত আসন্ন বোরো মৌসুমে একটি গভীর নলকূপ মোট ৯৮০ ঘণ্টা চলবে। ফলে এসব নলকূপের আওতাধীন জমিতে বোরো চাষ অর্ধেক থেকে শূন্যে নামিয়ে আনা হবে। পানি সংকটে এবার ধান চাষ হয়েছে তিন লাখ ৬৫ হাজার ৮৩০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছরের চেয়ে ১০ হাজার ২০০ হেক্টর কমেছে। তবে এই সংকট কাটাতে উদ্যোগ নিয়েছে বিএমডিএ।
বিএমডিএ বলছে, ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ স¤প্রচারণ (ইআইডিএল)’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইনটেক পাম্প স্টেশন গোদাগাড়ী পৌরসভা এলাকার জোত গোসাইদাস সারাংপুর থেকে বুস্টার-১ ও বুস্টার-২ পাম্প স্টেশন হয়ে দুধাই খালে পানি সরবরাহের জন্য এক হাজার মিলিমিটার ডায়ার এইচডিপিই পাইপ লাইন নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে। দুটি স্টেশন ক্রস করে খাড়িতে (জলাশয়) যাবে এই পানি।
প্রকল্পটি শেষ হলে এ অঞ্চলের ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর অনাবাদি জমি নতুন করে চাষের আওতায় আসবে এবং ৩০ হাজার কৃষক উপকৃত হবেন। সেই সঙ্গে প্রতি বছর এক লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন বাড়তি ফসল উৎপাদন হবে। এতে দেশীয় অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা যোগ হবে।
বিএমডিএ গোদাগাড়ী-১ জোনের সহকারী প্রকৌশলী আব্দুল লতিফ সরকার জানান, বরেন্দ্র অঞ্চলে ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাই এ অঞ্চলের পানির সংকট কমাতে এবং কৃষি আবাদে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে ‘ডাবল লিফটিং’ পদ্ধতিতে পদ্মা নদীর পানি বরেন্দ্র এলাকায় সরবরাহ ও সেচ সম্প্রচারণ (ইআইডিএল)’ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। ইনটেক পাম্প স্টেশন গোদাগাড়ী পৌরসভা এলাকার জোত গোসাইদাস সারাংপুর থেকে বুস্টার-১ ও বুস্টার-২ পাম্প স্টেশন হয়ে দুধাই খালে পানি সরবরাহ করে কৃষিজমিতে দেয়া হবে। ১৮ থেকে ২০ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে এই পানি সরবরাহ করা হবে।
তিনি জানান, প্রকল্পের কাজটি করছে শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী আরএফএল। এইচডিপি পাইপ দিয়ে ১২০ কিউসেক পানি সরবরাহ করা হবে। স্থাপন করা হবে ১২০টি এলএলপি পাম্প স্টেশন। এসব পাম্প থেকে কৃষকরা নতুন করে তাদের অনাবাদি জমি আবাদের আওতায় এনে ফসল উৎপাদন করতে পারবেন। এতে বহু কৃষকের উপকার হবে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রায় ২০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
গোদাগাড়ী উপজেলার বাসুদেবপুর এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এবারও পানির জন্য জমি চাষ করতে পারিনি। প্রতি বছরই ধানের সময় অর্ধেকেরও বেশি জমি চাষ করতে পারি না। ফলে অনেক ক্ষতি হয়। কিন্তু প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে জমিগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো চাষ করতে পারব মনে হয়। আরেক চাষি আবু হোসেন বলেন, ‘জমি চাষে পানি সংকট অনেক আগে থেকেই। পানির অভাবে বেশির ভাগ জমিতে চাষ করতে পারি না। বিশেষ করে ধান চাষ করতে গেলে অনেক সমস্যা হয়। প্রকল্পটি হলে আমাদের উপকারে আসবে। তবে তাদের এ প্রকল্পগুলো যথাসময়ে না হবার কারণে আমাদের কষ্টে মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
প্রকল্প পরিচালক শিবির আহমেদ জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৫৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, ২০২৭ সালের শুরুতে কাজ শেষ হলে কৃষকরা এর সুফল পেতে শুরু করবেন। তিনি জানান, এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে। পাশাপাশি নতুন করে ১০ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিকে চাষের আওতায় আনা যাবে। এতে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন অতিরিক্ত ফসল উৎপাদন হবে। স্থানীয় এক কৃষক বলেন, আমরা এখনও অনেক সময় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করি। কিন্তু পাম্প চালাতে বিদ্যুৎ বা ডিজেলের খরচ অনেক বেশি। যদি পদ্মার পানি পাই, তাহলে অনেক কম খরচে ফসল ফলানো যাবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু সেচ সুবিধাই নয়, কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন হবে বলেও মনে করছেন কৃষিবিদরা। কারণ সেচ সুবিধা বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা বছরে একাধিকবার ফসল চাষ করতে পারবেন। ফলে তাদের আয় বাড়বে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আসবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।

Discussion about this post