নিজস্ব প্রতিবেদক : ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক খাতে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় একের পর এক ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) পদত্যাগ বা অপসারণ করা হয়েছে। তবে ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি কোন কারণে তারা পদত্যাগ করছেন। চলতি বছরে প্রায় সাতটি ব্যাংকের এমডি পদত্যাগ করছেন। আবার কোন কোন ব্যাংকের এমডিকে অপসারণও করা হয়েছে। এর মধ্যে অনেক ব্যাংকের এমডিই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। ব্যাংকগুলো হলোÑসাউথইস্ট ব্যাংক, কমার্স ব্যাংক, মেঘনা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
সাউথইস্ট ব্যাংক: চলতি বছরের ২৮ জুলাই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেন পদত্যাগ করেছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার বিষয়টি ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে চলতি বছরের ৪ মে নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেনকে তিন মাসের ছুটিতে পাঠিয়েছিল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ, যা আগামী ৪ আগস্ট পর্যন্ত কার্যকর ছিল। এ সময় ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবিদুর রহমান চৌধুরী।
এর আগে ২০২৩ সালের ৫ এপ্রিল সাউথইস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন নুরুদ্দিন মো. ছাদেক হোসেন। এই নিয়োগের আগে তিনি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কমার্স ব্যাংক: বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকে ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের সিদ্ধান্ত ঘিরে সৃষ্ট বিতর্কের জেরে পদত্যাগ করেছেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে মোশারফ হোসেনের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন পর্ষদের কয়েকজন সদস্য। পরদিনই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দেন।
ব্যাংকের ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠান সুরুজ মিয়া স্পিনিং মিলসের নামে রয়েছে প্রায় ৮৮ কোটি টাকার ঋণ। এর বিপরীতে ব্যাংকটির পর্ষদ সম্প্রতি ৪৮ কোটি টাকা সুদ মওকুফের অনুমোদন দেয়। এ অনুমোদন বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, কমার্স ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মহসিন মিয়া অতীতে সুরুজ মিয়া স্পিনিংয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পর্ষদ চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের সঙ্গে তিনিও সুদ মওকুফে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাতে আপত্তি জানান।
ওই সূত্র জানায়, দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তিপত্র আনতে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। তিনি রাজি না হওয়ায় বৈঠকে তাকে অপসারণের হুমকি দেয়া হয়। পরদিন পদত্যাগ করেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যাংকটির নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
মোশারফ হোসেন চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিন বছরের জন্য যোগ দেন। এর আগে তিনি ইসলামিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের এমডি ছিলেন। ব্যাংকিং পেশায় তিনি যুক্ত হন ১৯৮৭ সালে উত্তরা ব্যাংকে অবেক্ষাধীন কর্মকর্তা হিসেবে।
মেঘনা ব্যাংক: চলতি বছরের ২৭ জুলাই মেঘনা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী আহসান খলিল পদত্যাগ করেছেন। পরিচালনা পর্ষদের সভায় ‘বাধ্যতামূলক’ ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্তের পর পদত্যাগ করেন কাজী আহসান খলিল। চাকরির মেয়াদ ১২ মাস বাকি থাকতেই সরে দাঁড়ালেন তিনি।
কাজী আহসান তার পদত্যাগ করার তথ্য দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যাংকের পর্ষদের কাছে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি। পর্ষদ আমাকে কারণ ছাড়াই ছুটিতে যেতে বলেছিল। আমি মনে করি আমার পদত্যাগপত্র দেয়া উচিত।
বয়স ৬৫ বছর হওয়া পর্যন্ত শর্তে ২০২৪ সালের এপ্রিলে কাজী আহসানকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী ২০২৬ মাসের মধ্য জুলাই পর্যন্ত তার মেয়াদ থাকার কথা। তবে দায়িত্ব নেওয়ার ১৫ মাসের মধ্যেই তিনি পদত্যাগ করলেন।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে মেঘনা ব্যাংকের একজন পরিচালক বলেন, ২৪ জুলাইয়ের পর্ষদ সভায় তাকে ‘বাধ্যতামূলক’ ছুটিতে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন।
ব্র্যাক ব্যাংক: চলতি বছরের ২৭ মে ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সেলিম আর এফ হোসেন পদত্যাগ করেন। সেলিম আর এফ হোসেন ২০১৫ সালের নভেম্বরে এমডি হিসেবে ব্র্যাক ব্যাংকের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। কয়েকবার মেয়াদ বৃদ্ধির পর আগামী বছরের মার্চ মাসে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এ বিষয়ে সাবেক ও বর্তমান পাঁচ এমডি জানান, সেলিম আর এফ হোসেন ব্র্যাক ব্যাংককে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। ব্র্যাক ব্যাংকে তার মতো একজন যোগ্য ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যাংকারের কর্মজীবন স্বাভাবিকভাবে শেষ না হওয়াটা সত্যিই দুঃখজনক। কারণ স্বাভাবিকভাবে কর্মজীবন শেষ হলে ব্যাংক খাতে তার আরও অবদান রাখার সুযোগ হতো।
ব্র্যাক ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে, যার প্রভাব পড়ে ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালনায়। ব্যাংকটির বিভিন্ন ফাইল আটকে রাখার পাশাপাশি পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করতে শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এ ছাড়া এবিবির চেয়ারম্যান হওয়ার পরও ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে এড়িয়ে চলে বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের একজন পরিচালকের সঙ্গে তার মতবিরোধ হয়। আবার একজন পরিচালক ব্যাংকে নিয়মিত অফিস করেন, এ নিয়েও তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। এর জের ধরেই পদত্যাগ করেন সেলিম আর এফ হোসেন।
যদিও সেলিম আর এফ হোসেন বলেছিলেন, স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি। পদত্যাগের কারণ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। আপাতত কোথাও যোগ দিচ্ছি না, ছুটি কাটাব।
ইসলামী ব্যাংক: ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ মুনিরুল মওলাকে পদ থেকে অপসারণ করেছে ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এই সিদ্ধান্তে অনাপত্তি জানায়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে অপসারণের সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে এক মাস পর। এই সময় পর্যন্ত তিনি এমডির সব সুবিধা ভোগ করবেন।
এর আগে চলতি বছরের ৬ এপ্রিল মুনিরুল মওলাকে বাধ্যতামূলক তিন মাসের ছুটিতে পাঠায় ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।
ব্যাংক সূত্র তখন জানায়, মুনিরুল মওলার বিরুদ্ধে উত্থাপিত বিভিন্ন অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানো হয়েছে। কমিশন এখন এসব অভিযোগ যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
ন্যাশনাল ব্যাংক: চলতি বছরের জানুয়ারিতে খেলাপি ঋণে জর্জর বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তৌহিদুল আলম খান ও ডিএমডি (উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক) আব্দুল মতিন পদত্যাগ করেন।

Discussion about this post