মো. মাঈন উদ্দীন : ব্যাংক খাতে সুশাসন, স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন খুবই জরুরি। বর্তমানে ব্যাংক খাতে নানারকম সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যেমন- খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ইত্যাদি। এই সমস্যাগুলো সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। অর্থনীতির হূদপিণ্ড হলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান। কাজেই দেশের অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের সমস্যাগুলো জরুরি ভিত্তিতে সমাধানের পদক্ষেপ নিতে হবে। সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে, সম্ভাবনাগুলো বের করে আনতে হবে। সমস্যা সমাধানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি বর্তমানে দেশের নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান সার্বিকভাবে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়েছে-কমেছে আয়, বেড়েছে ব্যয়। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় প্রভিশন ঘাটতি বেড়ে গেছে। ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে থাকা লোকজনের দুর্নীতির কারণেও ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ, অব্যবস্থাপনা ও জালিয়াতির ঘটনা বাড়ছে। এ কথা সবাই জানে, ব্যাংক খাতে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ঋণ বিতরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কাজেই খেলাপি ঋণ কমাতে হলে দুর্নীতি রোধ করে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। দেশের ব্যাংক খাতের অন্যতম বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ দিন দিন বৃদ্ধির মূল কারণ ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা মার্চের শেষে বেড়ে হয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। আশির দশকের প্রথম দিক থেকে দেশের অর্থনীতির আকার বাড়তে থাকলে তখন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ ১৯৭২ এবং ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এর ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হলে বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংক রয়েছে যার মধ্যে ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, ৪৩টি বেসরকারি ব্যাংক, ৯টি বিদেশি ব্যাংক ও তিনটি বিশেষায়িত ব্যাংক এছাড়া দেশে ৩৪টি দেশি-বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশের ব্যাংক খাতকে এগিয়ে নিতে বেশকিছু সংস্কার হয়েছে। কিছু সংস্কার ব্যাংক খাতকে সমৃদ্ধ করেছে আবার কিছু সংস্কার এর অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। এ খাতকে গতি গতিশীল করতে ২০০৯ সালের শেষের দিকে অটোমেটেড ক্লিয়ারিং প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আরটিজিএস হলো। ইলেকট্রিক ফান্ড ট্রান্সফার, আরটিজিএস এগুলোই আধুনিক ব্যাংকিং। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফাইন্যান্স সার্ভিসের যাত্রা শুরু হয়। চালু হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। এভাবেই দেশের ব্যাংক খাত এগিয়েছে ঠিকই কিন্তু শৃঙ্খলা, সুশাসন ও জবাবদিহির ক্ষেত্রে রয়েছে মারাত্মক ঘাটতি। বিগত পতিত স্বৈরাচার সরকারের আমলেই নানা অনিয়ম দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের কবলে পড়ে ব্যাংক খাত ভয়াবহ খাদের কিনারে এসে পড়ে। ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থার সংকট দেখা দেয়। বেড়ে যায় খেলাপি ঋণ, দেখা দেয় নানা ঋণ কেলেঙ্কারির ও বিদেশে অর্থ পাচার। ৫ আগস্ট ২০২৪এ পটপরিবর্তনের ফলে অন্তর্বর্তী সরকার আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভয়াবহ বিপদ থেকে সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ব্যাংকাররা জানান, বিগত সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক দখল, ঋণের নামে লুটসহ বিভিন্ন অনিয়ম হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণের ৮০ শতাংশই নিয়ে গেছে দখলদাররা। ফলে কোনো কোনো ব্যাংকের ৯৮ শতাংশ ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। এ রকম অবস্থায় চরম আস্থাহীনতায় পড়ে ব্যাংকগুলোর সঞ্চয় ভাঙার চাপ রয়েছে। আবার ঋণ আদায় সেভাবে হচ্ছে না। এসব ব্যাংক এখন ১২ থেকে ১৩ শতাংশ সুদ অফার করেও সাড়া পাচ্ছে না। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ ধার নিয়ে কোনো মতো চালু রেখেছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বেশি দিন চলতে পারে না। ব্যাংক খাতে সুশাসন, জবাবদিহি ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। এক্ষেত্রে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
এক. নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি জোরদারকরণ: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা অবশ্যই স্বাধীন ও শক্তিশালী হতে হবে যাতে কোনো রাজনৈতিক বা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর প্রভাব না থাকে।
রিস্ক ম্যানেজমেন্ট: ব্যাংকগুলোর জন্য আন্তর্জাতিক মানের (বেসেল ওওও) রিস্ক ম্যানেজমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যাসেল-৩ এর নীতি ও কৌশল ব্যাংক গুলোকে পরিপালন করা উচিত।
অডিট ও তদারকি: সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা আনয়নে রিস্ক বেইজড সুপারভিশন (RBS) পদ্ধতি চালুর কথা বলেছে। কিছু দিন আগে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, দেশের ব্যাংক খাতের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর কোনো ব্যাংককে তারল্য সহায়তা দিয়ে বাঁচানোর নীতিতে থাকবে না এবং গ্রাহক আস্থা হারালে তার দায় ব্যাংকগুলোর ওপরই বর্তাবে। এছাড়াও তিনি ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে রিস্ক বেইজড সুপারভিশন (RBS) পদ্ধতি চালু করার ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী বছরের (২০২৬) জানুয়ারি থেকে রিস্ক বেইজড সুপারভিশন (আরবিএস) পদ্ধতি চালু হবে। ৬১টা ব্যাংককে সুপার ভিশনের জন্য ১২ ভাগে বিভক্ত করে ১২টি কমিটি গঠন করা হবে। গভর্নর আরও বলেন, ব্যাংক খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনতে হলে রাজনীতিকদেরও শুদ্ধ হতে হবে। এ ধরনের সুপারভিশন যদি চালু হয় তাহলে আগামীদিনে এ খাতে সুশাসন ও শৃঙ্খলা সহজে ফিরে আসতে পারে তবে ভয় হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। নিয়মিত অডিট, বিশেষ করে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে স্বাধীন অডিট এবং রিয়েল-টাইম মনিটরিং সিস্টেম চালুর মাধ্যমে ও জবাবদিহি নিশ্চিত হতে পারে।
জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ: এ ক্ষেত্রে ব্যাংক বোর্ড ও ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব রয়েছে। ব্যাংক পরিচালনায় স্বচ্ছতা আনতে বোর্ড সদস্য ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনাকে দক্ষ ও নৈতিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অযোগ্য বা দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি কিছু নামকরা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। কারও কারও বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ও হয়েছে, কারও ব্যাংক হিসাব তলব করেছে। তাই সৎ, খোদাভীরু বা নৈতিকতাসম্পন্ন লোকদের চেয়ারম্যান, এমডি বা বোর্ডের সদস্য করা উচিত।
ক্লিয়ার পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর (কেপিআই): ব্যাংক কর্মকর্তাদের জন্য স্পষ্ট মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করে পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে পুরস্কার বা শাস্তির ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ বিশেষ করে ধর্মীয় অনুশাসন মানে এমন ব্যক্তি তৈরি করতে হবে। উত্তম নৈতিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিই উত্তম সেবা দিতে পারে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ ও কঠোর শাস্তি: কেলেঙ্কারি রোধ ও অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। মহাজনী ঋণ, জালিয়াতি বা সুপারিশভিত্তিক ঋণ বন্ধ করতে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন এবং ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থা (যেমন: ক্রেডিট স্কোরিং) চালু করা।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স: দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তা, ঋণগ্রহীতা বা রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া, যার মধ্যে জরিমানা, চাকরিচ্যুতি ও আইনি পদক্ষেপ অন্তর্ভুক্ত।
প্রযুক্তির ব্যবহার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ব্যাপকতা বৃদ্ধি করতে হবে। ব্লকচেইন প্রযুক্তির মতো উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে লেনদেনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা উচিত।
পাবলিক ডিসক্লোজার: ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা, ঋণের পরিমাণ ও ডিফল্ট রেট নিয়মিতভাবে প্রকাশ করা, যাতে জনগণ ও বিনিয়োগকারীরা সচেতন থাকতে পারেন।
ব্যাংক কোম্পানি আইন আধুনিকীকরণ: দুর্নীতি ও অদক্ষতা রোধে বিদ্যমান আইনকে আরও কঠোর করা। ব্যাংকিং জালিয়াতির মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত গঠন।
সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ—
নৈতিকতা ও গভর্ন্যান্স প্রশিক্ষণ: ব্যাংক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য গ্রাহকদের তাদের অধিকার ও সতর্কতা সম্পর্কে শিক্ষিত করা, যাতে তারা অস্বাভাবিক লেনদেন বা জালিয়াতি চিহ্নিত করতে পারেন।
রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা: নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ অনেকাংশে দায়ী। ঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে ও মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা থাকতে হবে।
ব্যাংক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাষ্ট্র, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধু কঠোর নিয়ম করলেই হবে না, সেগুলোর সঠিক বাস্তবায়ন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি গ্রহণ করতে হবে। এতে আর্থিক খাতের ভিত্তি মজবুত হবে, যা দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ব্যাংকার, কলাম লেখক
main706@gmail.com

Discussion about this post