রিশাদ আহমেদ : অনলাইন ক্লাস যেন কাগজের নৌকা—শুরুর দিকে সোজা পথে বয়ে চললেও মাঝপথে হাওয়ার টানে কখন যে গন্তব্য হারিয়ে ফেলে, কেউ জানে না। ক্লাসের প্রথম কয়েক মিনিট শিক্ষার্থীরা মনোযোগে ভাসলেও হঠাৎ করেই কেমন যেন রিলসের স্রোতে ভেসে যায়—মাউসের এক ক্লিক আর মন চলে যায় অন্য কোনো জগতে।
অনলাইন ক্লাসের সূচনা মূলত কভিড-১৯-এর সময় থেকেই। লকডাউনের কারণে যখন স্কুলের দরজায় তালা ঝুলল, তখন ল্যাপটপের স্ক্রিন হয়ে উঠল নতুন ব্ল্যাকবোর্ড আর মোবাইল ফোন ছিল ক্লাসরুমের একমাত্র দরজা। কিন্তু হঠাৎ করে আসা এই পরিবর্তনের জন্য শিক্ষকরা যেমন প্রস্তুত ছিলেন না, তেমনি শিক্ষার্থীরাও জানত না কীভাবে ডিভাইস হাতে নিয়ে পড়াশোনা করতে হয়। গ্রাম থেকে শহর—সব জায়গায়ই অনলাইন ক্লাস চালু হলেও ইন্টারনেটের ধীরগতি, পরিবারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা এবং পড়াশোনার উপযোগী পরিবেশের অভাবে অনেকেই নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারেনি। কেউ কেউ ডিভাইস জোগাড় করতে পারেনি, আবার কেউ সংযোগ পেলেও বারবার ছিটকে পড়েছে।
২০২৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জরিপে দেখা গেছে, অনলাইন ক্লাসে অংশ নেয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৬৫ শতাংশ স্বীকার করেছে, তারা ক্লাস চলাকালীন একাধিকবার অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে—কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ক্রল করছে, কেউ রিলস দেখছে, কেউ গেম খেলছে বা মেসেজ টাইপ করছে। আরেকটি বেসরকারি গবেষণায় জানা গেছে, ৪৫ মিনিটের অনলাইন ক্লাসে শিক্ষার্থীরা গড়ে প্রথম এক-তৃতীয়াংশ সময় মনোযোগ ধরে রাখতে পারে; তারপর ধীরে ধীরে মন অন্যদিকে সরে যায়। ইউনেস্কোর তথ্য বলছে, কভিড-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের শেখার ক্ষতি পূরণে অনলাইন ক্লাসের কার্যকারিতা ছিল মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ শতাংশের কোঠায়। অর্থাৎ প্রযুক্তি আনা হয়েছে, কিন্তু শিক্ষা ঠিকমত পৌঁছায়নি।
মনোযোগ হারানোর পেছনে কারণগুলো যুক্তিসঙ্গত। প্রথমত প্রযুক্তিগত বাধা। মাঝপথে নেটওয়ার্ক কেটে যাওয়া, সিগন্যাল দুর্বল হওয়া, অল্প অল্প ল্যাগ—এসবই শিক্ষার্থীর মনকে ক্লাস থেকে টেনে নিয়ে যায়। আমার এক পরিচিত ছাত্র বলেছিল, ‘ক্লাস চলাকালীনই হঠাৎ ভিডিও ফ্রিজ হয়ে যায়, তারপর মনোযোগ টুটে যায়।’ এই ‘টুটে যাওয়া’ আবার আরেকটি প্রবলেম ডেকে আনে—দুই-তিন মিনিট পর পুনরায় সংযোগ করলে কনটেক্সট হারিয়ে ফেলে এবং আগের আগ্রহ ফিরে আসে না।
দ্বিতীয়, সোশ্যাল মিডিয়ার টান। এক নোটিফিকেশন, একসা ধরে কারও পোস্ট দেখার কৌতূহল—এসবই মুহূর্তেই মনকে ভেঙে দেয়। রিলসের দ্রুত গতির ছবি-সাউন্ড আমাদের মস্তিষ্ককে দ্রুত সাড়া দেয়; লাম্বা লেকচার টেক্সটের তুলনায় রিলস অনেক বেশি আকর্ষণ করে। ফলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী একচেটিয়া মুহূর্তে ক্লাসে থাকলেও মন অন্য কোথাও ঘুরে বেড়ায়।
তৃতীয়ত, পারিবারিক পরিবেশ। সব পরিবারের ঘর অনলাইন ক্লাসের উপযোগী নয়। ছোট ভাইবোনের কোলাহল, রান্নাঘরের শব্দ, বাড়ির কাজ—এসবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভ্রাট মিলিয়ে দেয় মনকে। আমার ছোট ভাইয়ের স্কুল ক্লাস চলাকালীন পাশেই টিভির আওয়াজ থাকলে সে শুনতে পায় না; ক্লাসের কথাগুলো কানে ঢোকে কিন্তু মনে থাকে না—কারণ মন ব্যস্ত অন্য শব্দের সঙ্গে লড়ছে। আর যেখানে অভিভাবকরা কর্মব্যস্ত, সেখানে মনোযোগ বজায় রাখতে সহযোগিতা পাওয়া যায় না।
চতুর্থত—শিক্ষণ পদ্ধতির একঘেয়েমি। অনেক অনলাইন ক্লাসে শিক্ষক একপাশ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে কথা বলছেন; শিক্ষার্থীরা পাঠ শুনছেন—কেন্দ্রীয় ইন্টারঅ্যাকশন নেই। প্রশ্ন-উত্তরের সুযোগ কম, ছোট কার্যক্রম নেই; ফলে মন শূন্য রুটিনে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। একজন শিক্ষক যদি মাঝেমধ্যে ছোট কুইজ দেন, তখন মন ফিরে আসার সম্ভাবনা বাড়ে।
এ সম্মিলিত পরিস্থিতি কেবল শিক্ষার গুণমানেই ক্ষতি করছে না, বরং শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলছে। ধীরে ধীরে আত্মবিশ্বাস লোপ পাচ্ছে; পরীক্ষার সময় তারা উদ্বিগ্ন হয়, কারণ তারা জানে যে অনলাইন ক্লাসে পাওয়া শেখা অনেক সময় গভীরভাবে জমে না। দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ও কর্মক্ষমতায় পড়ে।
তবে আশা আছে, সমাধানও আছে এবং সেগুলো সময়োপযোগী ও বাস্তবসম্মত। প্রথমত, ক্লাসকে ছোট ছোট সেশনে ভাগ করুন। ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে মূল কাঠামো শেষ করে মিনিট দুই-তিন বিরতি দিন। মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট সময় পর দমনশীল হয়ে পড়ে; ছোট সেশন মনকে সতেজ রাখে। দ্বিতীয়ত, ইন্টারঅ্যাকটিভ উপাদান নিন—লাইভ কুইজ, পোল, ব্রেকআউট রুম বা সংক্ষিপ্ত গ্রুপ ডিসকাশন। কুইজ না হলে মন হারিয়ে যাবে; প্রশ্নে নিষ্ক্রিয়তা কমে, মনোযোগ বাড়ে। তৃতীয়ত, শিক্ষক প্রশিক্ষণ জরুরুি—অনলাইন শিক্ষার নিজস্ব কৌশল শেখাতে হবে: ভিজুয়াল হুক, স্টোরিটেলিং, পেইসিং ও অ্যাডাপটিভ ফিডব্যাকের ব্যবহার।
চতুর্থত, প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধান করা দরকার। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ইন্টারনেট সুবিধা বাড়াতে হবে; দরিদ্র পরিবারের জন্য ডিভাইস বিতরণ বা কমন্টিউনিটি লার্নিং সেন্টার চালু করা যেতে পারে। পঞ্চমত, ক্লাস চলাকালীন ডিজিটাল ডিটক্স প্রচলন করুন। নোটিফিকেশন অব, অনধিকৃত অ্যাপ ব্রাউজিং সীমিত রাখার পরামর্শ। অভিভাবকদেরও ভূমিকা যথেষ্ট, পড়ার সময় শান্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা, ছোট ভাইবোনকে অন্যত্র ব্যস্ত রাখা ইত্যাদি।
আরেকটি কার্যকরী কৌশল হয়েছে ‘হাইব্রিড পদ্ধতি’—আশপাশের ছোট ছোট টিউটরিং সেশন, সপ্তাহে একদিন মিলিত ক্লাস যেখানে মুখোমুখি আলোচনা হবে। অনলাইন ও অফলাইনের সমন্বয়ে শেখার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হয়। ক্যামেরা অন রাখার নীতিও কার্যকর—ছাত্ররা জানে যে তাদের উপস্থিতি বোঝা যাচ্ছে, তাই দায়িত্ববোধ বাড়তে পারে; অবশ্যই এটি করার সময় প্রাইভেসি ও সম্মতি বিবেচনায় রাখতে হবে।
শিক্ষকদেরও নিজেদের নিরন্তর আপডেট করতে হবে—মাত্র প্রযুক্তি আনা মানে সমাধান নয়; শিক্ষণ শৈলীর মান বদলাতে হবে। ছোট গল্প, বাস্তব উদাহরণ, প্রশ্ন-উত্তর ও শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ বাড়ালে ক্লাস প্রাণ পায়। অভিভাবক ও শিক্ষক যখন একসঙ্গে কাজ করবে, তখন অনলাইন ক্লাসের যে অভাব দেখা দিয়েছে তা অনেকটাই ঘুচবে।
অনলাইন শিক্ষাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়—এটি ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থার এক অংশ। কিন্তু প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিকতা না জুড়ালে তা কেবল শোরগোলই হয়ে থাকবে, বাস্তব শিক্ষা হবে না। তাই প্রয়োজন সমন্বিত প্রচেষ্টা, শিক্ষক প্রস্তুতি, পরিকল্পিত ক্লাস, প্রযুক্তি অবকাঠামো ও পরিবারের সহযোগিতা; সব মিলিয়েই অনলাইন ক্লাসকে কেবল নৌকা নয়, একটি স্থায়ী সেতু বানানো সম্ভব, যাতে গন্তব্য হারায় না।
শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

Discussion about this post