শেয়ার বিজ ডেস্ক : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর। ভ্রমণপিপাসু মানুষের পছন্দের শীর্ষে এই দর্শনীয় স্থানটি। চারপাশে সবুজ পাহাড় আর স্বচ্ছ জল ও সাদা পাথরের স্তূপ। ভ্রমণপিপাসুরা সাদা পাথরকে বাংলার কাশ্মীরও বলেন। তবে গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বিরামহীনভাবে চলছে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের পাথর লুট। নদীর তলদেশে বড় বড় গর্ত, ঘোলা পানি আর পাথরশূন্য মরুভূমি যেন এখানে নতুন বাস্তবতা।
পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, ৫ আগস্টের আগে যত দূর চোখ যেত, দেখা যেত সাদা সাদা পাথর আর পাথর। কিন্তু এখন সেখানে ধু-ধু বালুচর। তাদের ভাষ্যে, এক বছরে ১ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট পাথর লুট হয়েছে, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকার অধিক। পাথরের সঙ্গে বালুও লুট করা হচ্ছে। অথচ পর্যটনকেন্দ্রের চারদিকে বিজিবির চারটি ক্যাম্প ও পোস্ট রয়েছে।
জানা গেছে, প্রভাবশালী একটি চক্র দিনের আলোয় কিংবা গভীর রাতে শত শত নৌকায় পাথর তুলছে। এ চক্রের সঙ্গে জড়িতদের প্রভাব এতটাই বেশি যে সাধারণ মানুষ মুখ খুলতে সাহস পান না। কয়েক মাসের অব্যাহত লুটপাটে পাথরের স্তূপ উধাও, আর নদীর স্বচ্ছতা হারিয়ে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার এক বাসিন্দা বলেন, সাদা পাথর লুটপাট বন্ধের দাবিতে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, বিশেষ করে ইউএনও মহোদয় এবং সিলেট জেলা প্রশাসন, বিশেষ করে ডিসি মহোদয়কে একাধিকবার বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। প্রতিবারই তারা জানিয়েছেন, এ বিষয়ে তাদের অভিযান চলমান রয়েছে। কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তিনি আরও বলেন, দৃঢ়ভাবে আশা করি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই লুটপাটের অবসান ঘটাবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে সাদা পাথরের নাম পর্যটন মানচিত্র থেকে মুছে যেতে সময় লাগবে না। এতে শুধু পর্যটন নয়, জীবিকার ওপর নির্ভরশীল শতাধিক পরিবারও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, প্রশাসনের উদাসীনতা ও টিলেঢালা নজরদারির কারণে পাথরখেকোরা নির্বিঘ্নে তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে অভিযান চালালেও তার প্রভাব থাকে সামান্য সময়। এরপর আবারও লুটপাট চলে। একটি প্রভাবশালী মহল সাদা পাথর পর্যটনকেন্দ্র ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে বলে দাবি তাদের।
এ বিষয়ে ট্রাভেলার্স অব গ্রেটার সিলেটের অ্যাডমিন শেখ রাফি বলেন, সাদা পাথরের এই নির্বিচারে পাথর লুট শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধ্বংস করছে না, বরং পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় মানুষের জীবিকা সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে। প্রশাসনের চোখের সামনে এই অপরাধ চলা মানে অপরাধীদের সরাসরি প্রশ্রয় দেয়া। আমরা ট্যুর অপারেটররা খুবই ব্যথিত। কারণ এই ধ্বংসযজ্ঞ কেবল আমাদের পেশা নয়, আমাদের ভালোবাসার প্রকৃতিকেও হত্যা করছে। এখনই কঠোর আইন প্রয়োগ, দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং এই অবৈধ কর্মকাণ্ডের স্থায়ী অবসান প্রয়োজন, নইলে একদিন সাদা পাথর শুধু ছবিতে দেখার জায়গা হয়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগের সমন্বয়ক শাহ শাহেদা বলেন, যেহেতু খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় দাবি করে এই সম্পদ তাদের, সেহেতু এই জায়গায় তারা তদারকির দায়িত্বে আছে। এইযে পাথরগুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে, সুন্দর একটা জায়গা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, এগুলো দেখার মতো কেউ নেই।
তিনি আরও বলেন, সিলেট একটা অরক্ষিত জায়গা হয়ে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য কেউ আছে বলে মনে হয় না। পাথর সংরক্ষণে প্রশাসনের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। এই ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনার নেপথ্যের কুশীলবদের চিহ্নিত করা দরকার।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ বলেন, নিয়মিত আমাদের অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। জেলা থেকে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে অভিযান হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সহযোগিতা নিয়ে এই অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে কাজ চলছে।
কোম্পানীগঞ্জ থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ আদনান বলেন, সাদা পাথরকে কেন্দ্র করে ১৫টি মামলা হয়েছে। ৭০ জনের মতো আসামি গ্রেপ্তারও হয়েছে। স্থায়ীভাবে সাদা পাথর লুটপাট ঠেকাতে বড় অভিযানের প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
সাদা পাথরের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ চলছে তুমুল সমালোচনা। অনেকের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের পর্যটকদের কাছে পরিচিত সাদা পাথর পর্যটন স্পটটি বিলীন হয়ে যেতে পারে। সরকার হারাতে পারে বড় অঙ্কের রাজস্ব।

Discussion about this post