তৌহিদুল ইসলাম চঞ্চল : ভারতীয় সীমান্ত ঘেঁষা বাংলাদেশের একটি নদী তীরবর্তী ও অনগ্রসর গ্রামে বাস করেন মধ্যবয়সী পুরুষ আক্কাস আলী। নদী ভাঙনে সব হারিয়েছেন তিনি। ফলশ্রুতিতে বাধ্য হয়ে ভারত থেকে চোরাই পথে গরু নিয়ে এসে বেচেন তিনি। এই কাজ অবৈধ যার ফলে আইনের ঝুঁকি যেমন রয়েছে ঠিক তেমনি জীবনেরও ঝুঁকি আছে। পরিবারের মুখে দু’বেলা খাবার তুলে দেয়ার জন্য সব জেনেশুনেই এই কাজ শুরু করেন তিনি। এছাড়া তার আর কোনো উপায়ও ছিল না। অন্যদিকে তার স্ত্রী আঁকলি খাতুন ভারত থেকে কসমেটিকস ও শাড়ি এনে বিক্রি করেন। ইতোমধ্যে তাদের গ্রামে একটি সরকারি রাস্তার কাজে দিন মজুর হিসেবে কাজ করার কথা বলেছিলেন ইউপি সদস্য রহিম মিয়া। কিন্তু চোরাচালানের আয়ের তুলনায় সেই আয় নগণ্য মনে হওয়ায় তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের একমাত্র ছেলের নাম ফুটু মিয়া। তিনিও পকেট খরচের জন্য ফেনসিডিল পাচার শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে কৌতূহলবশত তিনি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েন। আসক্তির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেশার টাকার জন্য তিনি এখন যেকোনো অপরাধ করতে প্রস্তুত।
আক্কাস আলীর পরিবারের এই গল্পটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এটি আমাদের সীমান্তের এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে দারিদ্র্য, ঝুঁকি আর অপরাধ একে অপরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশ সবুজে মোড়ানো নয়নাভিরাম একটি দেশ, যার তিন দিকজুড়ে রয়েছে বিশাল সীমান্ত। একেক দেশ হিসেবে শুধু ভারতের সঙ্গেই আমাদের সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার, যা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ স্থলসীমান্ত। এর বাইরে, মিয়ানমারের সঙ্গে আছে আরও প্রায় ২৭২ কিলোমিটার সীমান্ত। সব মিলিয়ে, এই বিশাল ৪ হাজার ৪২৮ কিলোমিটারের সীমান্তরেখা শুধু একটি ভৌগোলিক সীমাই নয়, এটি কোটি কোটি মানুষের জীবন, আশা, আর সংগ্রামের একটি প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু এই সীমান্তের প্রতিটি কোণায় শুধু পাখির কলতান আর সবুজের সৌন্দর্যই বিরাজ করে না, এর আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু নির্মম বাস্তবতা। এই সীমান্তে প্রতি মুহূর্তে কিছু অপরাধের ঝুঁকি থাকে, যা দেশের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।
সীমান্তে ঘটে চলা অপরাধের ঝুঁকিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
* চোরাচালান: মাদক (যেমন- ইয়াবা, গাঁজা), স্বর্ণ, অস্ত্র, গরু এবং বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য চোরাচালান সীমান্ত এলাকার একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
* পুশ-ইন ও মানব পাচার: কিছু চক্র দারিদ্র্য ও অসহায়তার সুযোগ নিয়ে মানুষকে কাজের প্রলোভন দেখিয়ে জোরপূর্বক সীমান্ত পার করিয়ে দেয়, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সম্প্র্রতি ভারতের বিএসএফ আমাদের বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ না করেই অবৈধ উপায়ে সীমান্তে বহু মানুষকে ঠেলে পাঠিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইন পরিপন্থি। এক্ষেত্রে ভারতীয় নাগরিকদেরও ঠেলে পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে।
* অবৈধ অনুপ্রবেশ: কাজের সন্ধানে বা অন্য কোনো কারণে অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনাও ঘটে থাকে।
এসব অপরাধের পেছনে রয়েছে কিছু গভীর সামাজিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট।
* সামাজিক কারণ: সীমান্ত এলাকার অনেক মানুষ দারিদ্র্য ও শিক্ষার অভাবে ভোগে। জীবনধারণের মৌলিক প্রয়োজনে তারা দালালদের প্রলোভনে পড়ে এসব অবৈধ কাজে জড়িয়ে পড়ে।
* ভৌগোলিক কারণ: আমাদের সীমান্তের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে নদী, জঙ্গল ও দুর্গম পাহাড়। এসব জায়গায় নজরদারি করা অত্যন্ত কঠিন, যা অপরাধীদের জন্য একটি আদর্শ পরিবেশ তৈরি করে। সীমান্তের কিছু অংশ অরক্ষিত থাকলে তা অবৈধ কার্যকলাপের সুযোগ করে দেয়।
* অর্থনৈতিক কারণ: প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক অসমতা এসব অপরাধের একটি প্রধান কারণ। কোনো পণ্যের চাহিদা বাংলাদেশে বেশি হলে এবং দাম বেশি হলে, তার চোরাচালান বেড়ে যায়।
এসব অপরাধের ফলে দেশের বহুমুখী ক্ষতি হচ্ছে:
* অর্থনৈতিক ক্ষতি: চোরাচালানের কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। দেশীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অবৈধ ব্যবসার কারণে কালো টাকার বিস্তার ঘটে।
* সামাজিক ক্ষতি: মাদকের বিস্তার সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। তরুণ সমাজ আসক্ত হয়ে পড়ছে, যা তাদের ভবিষ্যৎ ধ্বংস করছে। মানব পাচার সমাজের মানবিক মূল্যবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
* জাতীয় নিরাপত্তা: অস্ত্র চোরাচালান দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে কি আমাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনী তথা বিজিবি কি ব্যর্থ হচ্ছে? না তারা ব্যর্থ নয়!
কারণ এই জটিল পরিস্থিতিতে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (ইএই) নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাদের সদস্যরা দিন-রাত এই বিশাল সীমান্ত পাহারা দিচ্ছে। তারা নিয়মিত টহল দেয়, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালায় এবং চোরাচালানকৃত পণ্য ও অপরাধীদের আটক করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিজিবি প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকেও মনোযোগ দিয়েছে, যেমন- রাতের অন্ধকারে নজরদারির জন্য বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করা।
তবে তাদের এই নিরন্তর চেষ্টার মধ্যেও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যেমন-
* সীমাবদ্ধ জনবল: ৪ হাজার ৪২৮ কিলোমিটার সীমান্ত পাহারা দেয়ার জন্য যে পরিমাণ জনবল প্রয়োজন, তা পর্যাপ্ত নেই।
* আধুনিক প্রযুক্তির অভাব: অনেক আধুনিক প্রযুক্তির অভাব থাকায় অনেক সময় অপরাধীদের কৌশল মোকাবিলা করা কঠিন হয়।
* ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা: দুর্গম এলাকার কারণে কিছু জায়গায় নিয়মিত টহল সম্ভব হয় না।
সার্বিক দিক বিবেচনা করলে আমাদের মনে একটি প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, সমস্যাটি শুধু কি বিজিবির একার পক্ষে সমাধান করা সম্ভব?
আমি বলব না সম্ভব না। এর জন্য সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। যেমন-
* সরকার: সরকারকে সীমান্ত ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বেশি বাজেট বরাদ্দ করতে হবে এবং বিজিবিকে আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত করতে হবে। পাশাপাশি, সীমান্ত এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
* স্থানীয় জনগণ: সীমান্ত এলাকার মানুষকে সচেতন হতে হবে। তাদের উচিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত না হওয়া এবং কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখলে দ্রুত বিজিবি-কে জানানো।
* সংবাদকর্মীরা: সংবাদকর্মীদের উচিত বস্তুনিষ্ঠভাবে সীমান্ত পরিস্থিতির ওপর প্রতিবেদন তৈরি করা, যাতে জনগণ ও সরকার এই সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারে এবং সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।
এই জটিল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রযুক্তি, জনবল এবং জনগণের সহযোগিতা— এই তিনের মেলবন্ধনই পারে সীমান্তকে সুরক্ষিত রাখতে। যদি সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা যায় এবং তাদের অর্থনৈতিক সুযোগ বৃদ্ধি পায়, তবে অপরাধ সংঘটনের মূল কারণ দূর হবে। পাশাপাশি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে শক্তিশালী কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনও জরুরি।
মানবসম্পদ প্রশিক্ষক

Discussion about this post