মনিরুল হক : দেশে বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচার বা আসবাবের কদর দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়াদের কাছে এ ধরনের আসবাবের প্রতি আগ্রহ বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ বাসার জায়গার সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে এমন আসবাবের জুড়ি নেই।
আসবাব ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব আসবাব দিয়ে একাধিক আসবাবের কাজ চালানো যায়। এ ধরনের আসবাবের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় খাট, যা রাতে ঘুমানোর জন্য ব্যাবহার করা যায়, আবার সেই খাট ভাঁজ করে সোফা হিসেবে ব্যাবহার যায়।
ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ছোট আয়তনের ফ্ল্যাটগুলোয় জায়গার স্বল্পতা থাকে। সাধারণত ৬০০ বর্গফুট বা এর কাছাকাছি আকারের মধ্যে থাকা বাসাবাড়িতে বসবাসকারী পরিবারের জন্য বড় আকারের প্রচলিত ফার্নিচার রাখা কষ্টকর। তাছাড়া অনেক ফ্ল্যাটে শিক্ষার্থীরা ব্যাচেলর হিসেবে থাকেন। ফলে এখন এমন আসবাব বেছে নিচ্ছেন আধুনিক নগরবাসীরা।
বর্তমানে হাতিল, রিগ্যাল ও আখতার ফার্নিচারের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় আসবাব প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শোরুমে জায়গা করে নিয়েছে বহুমুখী ব্যবহারের আসবাব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হাতিল ফার্নিচারের মনিপুরিপাড়া শাখার ম্যানেজার মো. সোহেল সিকদার শেয়ার বিজকে বলেন, ‘হাতিলে বহুমুখী ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয় ২০১৭ সাল থেকে। বর্তমানে আমাদের কাছে কয়েকটি মডেলের কনভার্টেবল ফার্নিচার আছে যার দাম ৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু। তবে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো সোফা কাম বেড ফার্নিচার।’ এ ধরনের আসবাবেব চাহিদা দিন দিন বাড়ছে বলে জানান তিনি।
আখতার ফার্নিচারের বিক্রয়কর্মীরা জানান, বহুমুখী ফার্নিচার শুধু জায়গা বাঁচায় না, বরং ব্যবহারকারীদের জীবনযাপনকে অনেক সহজ করে দেয়। বিশেষ করে ভাড়াটিয়া ও নতুন দম্পতিদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বেশি। ব্যাচেলররাও বহুমুখী ফার্নিচার ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে দেশের অনেক ই-কমার্সভিত্তিক ফার্নিচার প্রতিষ্ঠান ‘চায়না’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহুমুখী ফার্নিচার তৈরি করছে। এসব ফার্নিচারে ভাঁজ করার ব্যবস্থা, হালকা কিন্তু টেকসই কাঠামো এবং আধুনিক নকশা ব্যবহার করা হয়। ফলে এগুলো দেখতে যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি ব্যবহারেও সুবিধাজনক। উৎপাদন খরচও তুলনামূলকভাবে কম এবং একই ফার্নিচার বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা যায় বলে ক্রেতাদের পছন্দের তালিকায় উঠে এসেছে বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচার।
রাজধানী কল্যাণপুরের বাসিন্দা শফিকুল ইসলাম কান্ত এ ধরনের বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচার ব্যবহার করছেন। তিনি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমি দুই রুমের ফ্ল্যাটে থাকি। জায়গা কম তাই বেশি ফার্নিচার ব্যাবহার করতে পারতাম না। ছেলে-মেয়ের পড়ার টেবিল, আলমারি, খাটÑসব মিলিয়ে ঘরে ঠিকমতো হাঁটা-চলা করা যেত না। কিন্তু এখন একটি ফোল্ডেবল বেড আর ওয়াল-মাউন্টেড টেবিল কিনেছি। এতে আমার ছেলে-মেয়েও খুশি আবার ফোল্ডেবল হওয়ায় ঘরে জায়গাও বেশি হয়ে গেছে। তাছাড়া ঘর পরিস্কার করতেও অনেক সুবিধা হয়।’
রাজধানীর শনিরআখড়া এলাকার বাসিন্দা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আমি অনলাইনে বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচার দেখার পর আমার ছেলের জন্য একটি পড়ার টেবিল এবং একটি সোফা অর্ডার করি। টেবিলটা ভাঁজ করে দেয়ালে সেট করে রাখা যায় এবং সোফাটা টান দিয়ে খাটে পরিবর্তন করা যায়। এতে আমার অনেক সুবিধা হয়েছে। প্রথমত, আমার জায়গার সল্পতা থাকার পরও প্রয়োজন অনুসারে ফার্নিচার ব্যবহার করতে পারি। দ্বিতীয়ত, ফার্নিচারগুলো দেখতেও নান্দনিক।’
রাজধনীর বাসাবো এলাকার একজন গৃহিণী কলি চৌধুরী বলেন, ‘আমি একটি ছোট ফ্ল্যাটে বসবাস করি। আমি একটি ডাইনিং টেবিল কাম টি-টেবিল কিনেছি। আর একটি সোফা কাম বেড কিনেছি। অনেক সময় বাসায় হঠাৎ করে মেহমান চলে এলে সোফা কাম বেডটা আমার বেশি কাজে লাগে। মেহমান এলে বসতে দিতে পারি, আবার ওই সোফা টেনে খাট বানিয়ে শোয়ার কাজেও লাগাইতে পারি।’
খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, নগরায়ণ, উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্ব এবং ফ্ল্যাট ও প্লটের উচ্চমূল্যের কারণে আগামী দিনে বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচারের বাজার আরও সম্প্রসারিত হবে। একই সঙ্গে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও স্থানীয় উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলে এই খাতে শিক্ষিতদের কর্মসংস্থানও বাড়ছে।।
বর্তমানে ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীতেও বহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচারের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম থেকে সারা দেশের মানুষ এই ফার্নিচার কিনছেন।
ফার্নিচার শিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, ক্রেতাদের জীবনযাত্রা ও চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নতুন ডিজাইন ও প্রযুক্তি সংযোজনের মাধ্যমে বাজার আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছেন তারা।
অনলাইনভিত্তিক আসবাব প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ফার্নিকমের উদ্যোক্তা ময়নুল হোসেন শেয়ার বিজকে বলেন, ‘মহুমুখী ব্যবহারের ফার্নিচারের চাহিদা বাড়ছে। এর ফলে ফার্নিচার প্রস্তুতকারকরাও সেদিকে ঝুঁকছে। আমরাও এখন এ ধরনের সাশ্রয়ী ফার্নিচার বিক্রির দিকে মনোযোগ দিচ্ছি।’
বাংলাদেশ আসবাবপত্র শিল্প মালিক সমিতির প্রধান সেলিম রহমান জানান, বাংলাদেশের আসবাবপত্র উৎপাদনকারীরা তাদের উৎপাদিত আসবাবপত্র দিয়ে জাতীয় চাহিদার কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ পূরণ করতে পারে। তাছাড়া, বাংলাদেশে আসবাবপত্রের অভ্যন্তরীণ বাজারও উল্লেখযোগ্য, যার মূল্য প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা।
ফেসবুকভিত্তিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘মায়ের দোয়া চেয়ার হাউস’-এর ম্যানেজার মো. রাহাত হোসেন শেযার বিজকে বলেন, আমাদের অনেক ফার্নিচার আইটেম আছে, তবে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় সোফা কাম বেড, ফোল্ডিং বেঞ্চ কাম বেড এবং ফোল্ডিং ক্যাম্পিং বেড। এই বহুমুখী ফার্নিচারের দাম কম হওয়ায় এখন অনেক চাহিদা বেড়েছে, যত দিন যাচ্ছে এই ফার্নিচারের চাহিদা তত বাড়ছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মূলত মেটাল এবং স্টিলের ফার্নিচার বানাই। মেটাল দিয়ে তৈরি ফার্নিচারগুলো ১০ বছর এবং স্টিল দিয়ে তৈরি ফার্নিচারগুলোয় ২০ বছরের গ্যারান্টি দিয়ে থাকি।’

Discussion about this post