শেয়ার বিজ ডেস্ক : দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারের নেতারা স্বল্প উন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের সময়সীমা তিন থেকে পাঁচ বছর পিছিয়ে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। তাদের যুক্তি, গত কয়েক বছরে দেশের অর্থনীতি যে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে গেছে, তাতে এই মুহূর্তে গ্র্যাজুয়েশনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া সম্ভব হয়নি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, কভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি, ব্যাংকের উচ্চ সুদের হার, গত বছরের জুলাই-আগস্টে রাজনৈতিক অস্থিরতা, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং সর্বশেষ ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত উচ্চ শুল্ক সব মিলিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই অবস্থায় সুষ্ঠু ও নিরাপদভাবে গ্র্যাজুয়েশনের পথে এগোনো কঠিন।
ঢাকার একটি স্থানীয় হোটেলে ‘এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন: বাংলাদেশের জন্য কিছু বিকল্প’ শীর্ষক সেমিনারে গতকাল শুক্রবার এ দাবি জানানো হয়। সেমিনারের আয়োজনকে ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশ (আইসিসি-বি), বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ (বাপি)। এতে অংশ নেন দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা, আমদানি-রপ্তানিকারক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা।
ব্যবসায়ীরা প্রস্তাব করেন, দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন ও চেম্বারের স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র তৈরি করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের কাছে জমা দেয়া হোক, যাতে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সময়সীমা বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হবে।
এছাড়া তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, এখনই বড় বাণিজ্যিক অংশীদারদের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) ও অন্যান্য বাণিজ্যিক চুক্তি করতে, যাতে গ্র্যাজুয়েশনের পরও বাংলাদেশ রপ্তানিতে শুল্ক সুবিধা বজায় রাখতে পারে।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন আইসিসি-বি’র সভাপতি মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, গ্র্যাজুয়েশন হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশ অধিকার হারাতে হবে। ইইউতে শুল্ক ১২ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে, যা রপ্তানি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে যদি নাজি এসপি বা অনুরূপ সুবিধা নিশ্চিত করা যায়।
তিনি আরও বলেন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন মানে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিউটিও) বিশেষ সুবিধাগুলোর অবসান যেমন রপ্তানি ভর্তুকি, জেনেরিক ওষুধে সহজ মেধাস্বত্ব আইন, উৎপাদন খরচ কমানোর জন্য শিথিল উৎস নিয়ম। ফলে ঋণের শর্ত কঠোর হবে, সুদ বেড়ে যাবে এবং উৎপাদন খরচ ও বাড়বে।
মাহবুবুর রহমানের ভাষায় ‘প্রশ্নটা এখন আর এই নয় যে আমরা গ্র্যাজুয়েট হব কিনা? তা ঠিক হয়ে গেছে। চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে আমরা সফলভাবে গ্র্যাজুয়েট হব। এর মানে বাজারে প্রবেশাধিকার রক্ষা, প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা গড়ে তোলা এবং শুধু পরিকল্পনা নয়, দ্রত পদক্ষেপ নেয়া।’
মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্কের (টিডবিউএন) আইন উপদেষ্টা ও জ্যেষ্ঠ গবেষক সানিয়া রেইড স্মিথ। তিনি এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের সম্ভাব্য প্রভাব তুলে ধরেন।
স্মিথ বলেন, গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মেধাস্বত্ব (ট্রিপস) নিয়ম মানতে হবে, যেখানে নতুন ওষুধে ২০ বছরের পেটেন্ট প্রযোজ্য। এতে বাজারে জেনেরিক ওষুধ আসতে দেরি হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, গ্র্যাজুয়েশনের পর ইনসুলিনের দাম বাংলাদেশে ১১ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে, ফলে ইনসুলিন প্রয়োজন এমন পরিবারের দারিদ্র্যের হার ১৫ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
তিনি আরও উল্লেখ করেন, এইডস চিকিৎসার একটি পেটেন্ট যুক্ত ওষুধের বার্ষিক খরচ যেখানে রোগী প্রতি ১৫ হাজার ডলার, সেখানে জেনেরিক সংস্করণের খরচ মাত্র ৬১ ডলার। মালয়েশিয়াতে দেখা গেছে, পেটেন্ট যুক্ত ওষুধ জেনেরিকের তুলনায় ১,০৪৪ শতাংশ বেশি দামি।
স্মিথ উদাহরণ দেন, অ্যাঙ্গোলা ২০১৮ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কথা থাকলেও সময় বাড়িয়ে নেয়, পরে ২০২৪ সালে তারা আর গ্র্যাজুয়েশনের মানদণ্ড পূরণ করতে পারেনি। তাই তাদের জন্য এখন কোনো নির্ধারিত সময়সীমা নেই। একইভাবে তিমুর-লেস্তে ২০২১ সালে এবং মিয়ানমার ২০২৪ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার কথা থাকলেও সময়সীমা নির্ধারিত হয়নি।
তিনি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ রপ্তানি যায় ইইউতে এবং এর ৯৩ শতাংশ পণ্য এলডি হিসেবে শূন্য শুল্কে প্রবেশ করে। গ্র্যাজুয়েশনের পর এই সুবিধা হারাবে।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়ার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘এখন গ্র্যাজুয়েশন করা আত্মঘাতী সদ্ধা হবে, কারণ অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি এক নজিরবিহীন ধাক্কার মুখে। এতে প্রতিযোগী দেশগুলো সুবিধা পেয়ে যাবে।’
আইসিসি-বি’র সহ-সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, গ্যাসের মজুত দ্রত শেষ হচ্ছে, তাই আগামী কয়েক বছরে গ্যাস আমদানিতে ৪ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে। তিনি ব্যবসায়ীদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্রুত প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি পাঠানোর আহ্বান জানান।
সভাপতি আবদুল মুক্তাদির বলেন, গত ছয় বছরে কভিড-১৯, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার, উচ্চ ব্যাংক সুদের হার সব মিলিয়ে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাই বাংলাদেশের আর ও ছয় বছরের সময় প্রয়োজন।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, কিন্তু সময় দরকার। কারণ এখন আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হবে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়াও ভারতের সঙ্গে।’

Discussion about this post