ভাষা আন্দোলনে ছাত্র সমাজের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এটি ছিল একটি ছাত্র-অধ্যুষিত আন্দোলন, যেখানে ছাত্ররা ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করেনি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হচ্ছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। স্বাধীন বংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের পেছনে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় পূর্ব বাংলায় উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি সারা রাত ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে কাজ করে, যা ফেব্রুয়ারির ২৪ তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ যুক্ত করা হয়েছিল যাতে লেখা ছিল ‘শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ’। কোনো রাষ্ট্রের পার্লামেন্টে, প্রশাসনে ও আদালতের কার্যক্রমে যে ভাষা ব্যবহূত হয়, সেটাকে বলা হয় সরকারি ভাষা বা রাষ্ট্রভাষা। ভাষা আন্দোলন ছিল ছাত্রদের আন্দোলন। ছাত্ররাই প্রতিবাদ করেছিল, ছাত্ররাই মিছিল করেছিল এবং ছাত্ররাই জেলে গিয়েছিল। যেসব ছাত্র সোচ্চার হয়েছিল তারা নিশ্চয়ই ভবিষ্যতে পার্লামেন্টে, প্রশাসনে ও আদালতের কার্যক্রমে তাদের কী সুবিধা-অসুবিধা হবে সেটা ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। ১৯৪৮-এ তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া এবং ১৯৫২-তে আন্দোলনের সূচনায় তারা বুঝেছিল তাদের মাতৃভাষা বাংলা এমন একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের মুখে পড়েছে যাকে সর্বশক্তি দিয়ে রোধ না করলে এ ভূখণ্ডের বাঙালি জাতির বৈশিষ্ট্য হবে নিশ্চিহ্ন এবং অস্তিত্ব হবে বিপন্ন। সেই উত্তাল সময়ের প্রেক্ষাপটে ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। মাতৃভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তারা। পুলিশি নির্যাতন, গুলির মুখে নিজের জীবন বিপন্ন করে তারা অংশ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন সেই সময়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্র, ভাষাসৈনিক আলী আজমল। যিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষানলের শিকার হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। তার এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ অন্যায়ভাবে কেড়ে নিয়েছিল তখনকার সরকার। এমবিবিএস কোর্স সম্পন্ন করতে না পারলেও তিনি পরবর্তী সময় সনদবিহীন ডাক্তার হিসেবে নিজ এলাকার আর্ত মানবতার সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন নিজেকে, আজীবন দুস্থ গরিব মানুষের চিকিৎসা করে গেছেন বিনা খরচে। নিজের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎকে সেই মানুষটি অকাতরে ত্যাগ করেছিলেন। নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছিলেন নিয়তির লিখন। সেই মহান ভাষাসৈনিকের জীবনের অজানা অধ্যায়ের কথা তুলে ধরতে তার আত্মজা রওনাক আজমল উদ্যোগী হয়ে একটি গ্রন্থ ‘নিভৃতচারী ভাষাসৈনিক আলী আজমল ও বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অজানা কিছু কথা’ প্রকাশ করেছেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে হয়তো তার নামটি অনেকের কাছে অজানা অচেনা মনে হলেও সেই উত্তাল সময়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে, নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের অনিশ্চতার মধ্যে নিক্ষেপ করে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। এই গ্রন্থে বিভিন্ন লেখায় তা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটিকে তার পরিবারের সদস্য, ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণমূলক লেখা সংকলন গ্রন্থ বলা যায়। সম্পাদনা করেছেন রওনাক আজমল। সবাই খুব কাছ থেকে দেখা মানুষটির কথা চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন এখানে। শিক্ষাবিদ কন্যা রওনাক আজমল ভাষা আন্দোলনে অসাধারণ ভূমিকা পালনকারী বাবার অবদানকে সবার সামনে তুলে ধরতে যেভাবে উদ্যোগী হয়েছেন তা প্রশংসনীয়। ১৭৬ পৃষ্ঠার বইটিতে বিভিন্ন জনের ২৭টি লেখা সংকলিত হয়েছে। প্রতিটি লেখাই অত্যন্ত প্রাঞ্জল। অনন্য ব্যক্তিত্ব ভাষা সৈনিক আলী আজমলের সঙ্গে স্মৃতিময় সময়ের প্রাণবন্ত বিবরণ; যা পড়তে পড়তে পাঠক তার ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের অনেক অজানা কথা জানতে পারবেন।
গ্রন্থটির শেষ দিকে মহান ব্যক্তিত্ব নিভৃতচারী ভাষাসৈনিকের জীবনের বিভিন্ন সময়ের মূল্যবান আলোকচিত্র সন্নিবেশিত হয়েছে; যা গ্রন্থটির আকর্ষণ বৃদ্ধি করেছে স্বাভাবিকভাবেই।
এই মূল্যবান গ্রন্থটি আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে একজন অকুতোভয় বীর, ত্যাগী মানুষ, অসাধারণ ভাষাসৈনিককে পরিচিত করবে নিঃসন্দেহে। এটি পড়ে তারা উদ্দীপ্ত হবে অন্যায়, অবিচার, সব ধরনের শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে। নতুন প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন যে ছাত্রদের দ্বারাই পরিচালিত হয়েছিল সে সত্য প্রতিষ্ঠায় সচেতন থাকবে এবং মহান ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাসকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে বিশ্ব ভাষার মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থাকবে। ‘নিভৃতচারী ভাষাসৈনিক আলী আজমল ও বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অজানা কিছু কথা’ গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ধ্রুবতারা প্রকাশনী। গ্রন্থটির মূল্য ৪৫০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
রেজাউল করিম খোকন— নাজনীন নাহরিন স্নিগ্ধা, শফিক আবরার, ইউসুফ খালিদ, অনন্য রেজা করিম

Discussion about this post