নিজস্ব প্রতিবেদক : বাণিজ্যিক যানবাহনের ফিটনেস সনদ নবায়নের সময় অগ্রিম আয়কর পরিশোধের বিধান থাকলেও ফিটনেসবিহীন বহু যানবাহনের কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষে এই কর আদায় করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। ফিটনেস নবায়নের সময় ব্যাংকে জমা দেয়া কর চালান বিআরটিএতে দাখিল করে যানবাহনের মালিকরা। চালানের অর্থ নির্ধারিত কোডে জমা দেয় বিআরটিএ।
তবে যে যানবাহনগুলোর ফিটনেস নবায়ন করা হয় না, সেগুলোর কর আদায় করা যাচ্ছে না। ফলে রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
বিআরটিএর দেয়া তথ্যে জানা গেছে, দেশে প্রায় ৫০ হাজার বাণিজ্যিক যানবাহনের (বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলার) হালনাগাদ ফিটনেস সনদ নেই। এই ফাঁকে সড়কে চলাচল করছে এসব ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যা রাজস্ব ফাঁকির পাশাপাশি যাত্রী নিরাপত্তাকে ঝুঁকিতে ফেলছে।
ফিটনেস নবায়নে নেই বিআরটিএ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা এনবিআরের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম। রাজস্ব আহরণেও দেখা যাচ্ছে না কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের কোনো উদ্যোগ।
এনবিআরের কর জরিপ ও পরিদর্শন সদস্য বলেন, ‘এসব রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের। কেন তারা পদক্ষেপ নেয়নি, তা খতিয়ে দেখব। আয়কর আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। নির্ধারিত কর না দিলে জরিমানাসহ কয়েক গুণ কর দিতে হয়।’
বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে গণপরিবহন হিসেবে ব্যবহƒত বাস, মিনিবাস ও হিউম্যান হলারের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৬৬৮টি। এর মধ্যে বাস ৫৬ হাজার ৭৩৩টি, মিনিবাস ২৮ হাজার ৫৬১টি এবং হিউম্যান হলার ১৭ হাজার ৩৭৪টি।
ফিটনেস সনদ নেই এমন যানবাহনের মধ্যে রয়েছে ২৩ হাজার ৬৬৫টি বাস, ১১ হাজার ৯০৫টি মিনিবাস ও ১৪ হাজার ৫১০টি হিউম্যান হলার।
অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫ অনুযায়ী, ৫২ আসনের কম বাসের প্রতিটির জন্য ২০ হাজার টাকা, মিনিবাসের জন্য ১২ হাজার ৫০০ টাকা এবং হিউম্যান হলারের জন্য ৭ হাজার ৫০০ টাকা অগ্রিম কর নির্ধারিত রয়েছে। এর আগে অর্থ বিল ২০২৪ অনুযায়ী, একই যানবাহনের ক্ষেত্রে যথাক্রমে ১১ হাজার ৫০০, ৬ হাজার ৫০০ এবং ৪ হাজার টাকা করে কর নির্ধারিত ছিল।
এই হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার হারিয়েছে ৪০ কোটি ৭৫ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ফিটনেস নবায়ন না হলে রাজস্ব হারানোর পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭৩ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা।
কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চলের কমিশনার বলেন, ‘তদারকি শুধু আমাদের নয়, দেশের সব কর অঞ্চলের। কারণ এসব টিআইএন বিভিন্ন কর অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।’
একই সূত্র জানায়, বিআরটিএর রাজস্ব আহরণ মনিটরিংয়ের দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র দুজন কর পরিদর্শক। তারা বিআরটিএর সিএনএস সিস্টেমের মাধ্যমে রিয়েল টাইমে রাজস্ব পর্যবেক্ষণ করেন।
গত মার্চে এক ত্রুটিতে দেখা যায়, এনবিআরের রাজস্ব বিআরটিএর ভিন্ন কোডে জমা হচ্ছিল। বিষয়টি চিহ্নিত করে মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রককে অবহিত করা হয় এবং প্রায় ১ হাজার ৬৪ কোটি টাকা ফেরত আনা হয়।
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে দেশে পুরোনো ও অনিরাপদ যানবাহন সড়ক থেকে সরিয়ে ফেলার সরকারের পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ হিসেবে মূলত পরিবহন মালিক ও সিন্ডিকেট নেতাদের প্রভাব, চাঁদাবাজি ও ধর্মঘটের হুমকির বিরুদ্ধে সরকার কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) ‘ফিটনেসবিহীন’ গাড়ি সড়ক থেকে সরানোর অভিযান শুরু হতেই পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠন ধর্মঘটের হুমকি দেয়। সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হলে বাধ্য হয়ে নতি স্বীকার করতে হয়েছে। এতে করে পরিবহন খাতের সংস্কার ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির অগ্রগতি থমকে গেছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের মধ্যে গভীর উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল জনসাধারণের জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এতে সড়ক দুর্ঘটনা, যানজট ও নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে।

Discussion about this post