নিজস্ব প্রতিবেদক : রাষ্ট্রায়ত্ত, বিশেষায়িত ও বেসরকারি মিলিয়ে মোট ২৩টি ব্যাংক বর্তমানে মূলধন ঘাটতির মধ্যে রয়েছে। এদের সম্মিলিত ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১১ হাজার ২৮৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ করা প্রতিবেদনে এ তথ্য ওঠে এসেছে। এ তথ্য মার্চ মাসের। এতে বলা হয়, মূলধন ঘাটতির পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ঋণ বিতরণ, যার বড় একটি অংশ এখন আর ফেরত পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ঘাটতির বোঝা চাপছে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঁধেÑআর এতে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মূলধন ঘাটতি কেবল আর্থিক দুর্বলতার চিত্র নয়, বরং এটি দেশের ব্যাংকিং খাতের গভীর কাঠামোগত সমস্যার প্রতিচ্ছবি। দীর্ঘদিন ধরে চলা অব্যবস্থাপনা, দুর্বল পরিচালনা পর্ষদ, রাজনৈতিক প্রভাব এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব এই অবস্থার জন্য দায়ী।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন করে মূলধন ঘাটতির মধ্যে পড়েছে একাধিক ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছেÑ ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এবং আইএফআইসি ব্যাংক।
বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের পরিবর্তনের পর এসব ব্যাংকের ভেতরের আর্থিক দুর্বলতা ও ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। অতীতে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অনেক ব্যাংক যেমন অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণে জড়িত ছিল, বর্তমান বাস্তবতায় তার প্রভাবই মূলধন ঘাটতির রূপে সামনে আসছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ২৩টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাটতিতে রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের, যার ঘাটতির পরিমাণ ১৮ হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। এর পরেই রয়েছে ইউনিয়ন ব্যাংক, তাদের ঘাটতি ১৭ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ১২ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা, এস আলমের নিয়ন্ত্রণে থাকা আরেক প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ৭ হাজার ৭৯০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৬ হাজার ৯৩৮ কোটি ৭০ লাখ টাকা, এস আলমের দখলে থাকা ইসলামী ব্যাংকের ঘাটতি ৬ হাজার ৪৫৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
এছাড়া রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ঘাটতি ৫ হাজার ৮২২ কোটি টাকা, পদ্মা ব্যাংকের ৫ হাজার ১৭০ কোটি ৭০ লাখ টাকা, রূপালী ব্যাংকের ৪ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৮০ কোটি ৬১ লাখ টাকা, এবি ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৯৩ কোটি টাকা এবং বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা।
তালিকায় আরও আইএফআইসি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা, বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ২ হাজার ৫১০ কোটি ৬৯ লাখ, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৯৭৯ কোটি ৮১ লাখ বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ১ হাজার ৭৮২ কোটি, আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৯৮ কোটি, প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১ হাজার ১৭১ কোটি, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ৯৫৪ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের ৫২১ কোটি, সিটিজেনস ব্যাংকের ৮৬ কোটি সীমান্ত ব্যাংকের ২৬ কোটি এবং বিদেশি হাবিব ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩৬ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যেও ২/১টি ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের বিষয়ে গভর্নর নিজেই একাধিকবার সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকও এই সংকট মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। জানা গেছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুব শিগগিরই পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করতে যাচ্ছে। এসব ব্যাংক ইতোমধ্যেই মূলধন ঘাটতির তালিকায় রয়েছে। শুধু তাই নয়, আরও প্রায় ১১টি ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা মূল্যায়ন করা হচ্ছে, যেগুলোর অবস্থাও কমবেশি একই রকম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে তারা মূলধন ঘাটতি পূরণের একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা চাইবে। এই পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে বাধ্যতামূলক প্রশাসনিক ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পুরো ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। খেলাপি ঋণ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের জাল ছিন্ন করেই কেবল খাতটি পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা পর্যবেক্ষণ জোরদার করেছে এবং ঘাটতিপূর্ণ ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। তবে বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথাÑ এই ব্যাংকগুলো একাধিকবার সময় পেলেও ঘাটতি কাটাতে পারেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকির ঘাটতি, দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার অভাবেও ব্যাংকগুলোর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরছে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মার্চ শেষে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৪১ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

Discussion about this post