নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশের ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা ও নানা অনিয়মের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে তিনটি বেসরকারি ব্যাংকের সম্পদ মান যাচাই (অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ-একিউআর) করতে বিশেষ অডিট কার্যক্রম শুরু করেছে বৈশ্বিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ডেলয়েট। সংশ্লিষ্ট তিন ব্যাংক হলো-এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক এবং ন্যাশনাল ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ অডিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ডেলয়েট আনুষ্ঠানিকভাবে গত বুধবার কার্যক্রম শুরু করেছে। সেদিন প্রতিষ্ঠানটির একটি টিম আইএফআইসি ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে পরিদর্শন করে। এ সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন। কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ অডিট শেষে প্রতিটি ব্যাংকের প্রকৃত আর্থিক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ কার্যক্রম বাস্তবায়নে অর্থায়ন করছে বিশ্বব্যাংক। সব মিলিয়ে ১১টি ব্যাংকের সম্পদ মান যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম ধাপে এবি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এরপর পর্যায়ক্রমে বাকি আটটি ব্যাংকের একিউআর সম্পন্ন হবে।
পরবর্তী তালিকায় রয়েছেÑবাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, মেঘনা ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবিসি ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ইউসিবি ব্যাংক এবং আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক।
অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউয়ের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ঋণ পরিস্থিতি, খেলাপি ঋণের সঠিক পরিমাণ, প্রভিশন ঘাটতি, মূলধন ঘাটতি এবং গ্রাহকের আমানতের অবস্থা খতিয়ে দেখা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, এই বিশেষ অডিট ব্যাংকগুলোর আর্থিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ চিত্র তুলে ধরবে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও দুর্বল করপোরেট গভর্ন্যান্স ব্যাংক খাতকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে। ফলে সাধারণ গ্রাহকের আস্থা কমছে, একইসঙ্গে বাড়ছে চাপ। বিশেষ অডিটের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে এলে সেক্টরটিতে সংস্কারের পথ তৈরি হতে পারে।
এর আগে আন্তর্জাতিক নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান আর্নেস্ট অ্যান্ড ইয়াং এবং কেপিএমজি মোট ছয়টি ব্যাংকের অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ সম্পন্ন করেছে। ব্যাংকগুলো হলোÑএক্সিম ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক এবং ইউনিয়ন ব্যাংক।
রিভিউতে দেখা যায়, ওই ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। অধিকাংশেরই খেলাপি ঋণ বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে, মূলধন ঘাটতি তৈরি হয়েছে আর প্রভিশনের ঘাটতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
বিশেষ অডিটের ফলাফলের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয়Ñএই ব্যাংকগুলোকে একীভূত করে নতুন ব্যাংক গঠন করা হবে। তবে বিদেশি মালিকানার কারণে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংককে এ প্রক্রিয়ার বাইরে রাখা হয়েছে। বাকি পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন ব্যাংক গঠনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একিউআর কার্যক্রম ব্যাংক খাতকে সুস্থ ও টেকসই পথে ফেরানোর একটি কার্যকর পদক্ষেপ। সাধারণ নিরীক্ষায় যেসব অনিয়ম ও দুর্বলতা ধরা পড়ে না, বিশেষ অডিটের মাধ্যমে সেগুলো স্পষ্ট হয়। ফলে নীতিনির্ধারকদের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেয়া সহজ হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক এক কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রকৃত তথ্য গোপন করা। বিশেষ অডিটের মাধ্যমে সেটি প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদি এটি নিয়মিতভাবে চালু রাখা যায়, তাহলে ব্যাংক খাত অনেকটা স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ‘এবি, আইএফআইসি ও ন্যাশনাল ব্যাংকের অডিট শেষে রিপোর্ট হাতে এলে সেসব ব্যাংকের ভবিষ্যৎ নিয়ে নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এর মধ্যে প্রয়োজন হলে পুনর্গঠন, একীভূতকরণ কিংবা ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপও আসতে পারে।’
অন্যদিকে, বাকি আটটি ব্যাংকের রিভিউ সম্পন্ন হলে ব্যাংক খাতের সামগ্রিক চিত্র আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

Discussion about this post