আসাদুজ্জামান রাসেল, রাজশাহী : এক সময়ের প্রাণবন্ত শিল্পাঞ্চল হিসেবে খ্যাত রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরী এখন ধুঁকছে অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও সিদ্ধান্তহীনতার বোঝায়। পুরাতন বিসিক (বিসিক-১) এ অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়েছে, মালিকরা বেআইনিভাবে প্লট ভাড়া দিয়ে মাসে লক্ষাধিক টাকা আয় করলেও নেই কোনো উৎপাদন। অপরদিকে নতুন বিসিক-২ স্থাপনের পরও তাতে কার্যকর উৎপাদন শুরু হয়নি। এমন বাস্তবতায় রাজশাহীর শিল্প সম্ভাবনা এখন মারাত্মকভাবে বিঘিœত হচ্ছে। ১৯৬১ সালে রাজশাহীতে বিসিকের যাত্রা শুরু হয়। সুষ্ঠুভাবে ব্যবসা পরিচালনার জন্য বিসিক এখানে উদ্যোক্তাদের বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, নিরাপত্তা, রাস্তা ও ড্রেনেজ সুবিধাদি প্রদান করে থাকে। কিন্তু সেসবই এখন খাতা-কলমে, বাস্তবতা বলছে ভিন্ন চিত্রের কথা। একসময়ের উৎপাদন কেন্দ এখন ‘ভাড়ার হাট’।
রাজশাহীর সপুরায় অবস্থিত বিসিক শিল্পনগরী-১ এ ২০০টি কারখানার মধ্যে কাগজে-কলমে ১৫টি বন্ধ বলে উল্লেখ থাকলেও অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রায় ৫০টিরও বেশি কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এর অধিকাংশই বেআইনিভাবে ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। কেউ করেছে বসবাসের ব্যবস্থাপনা, কেউ বানিয়েছে গুদামঘর বা দোকান। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহƒত হচ্ছে ভিন্ন উদ্দেশ্যে, অথচ উদ্যোক্তারা নতুন প্লট পাচ্ছেন না।
বিসিকের তথ্যে জানা যায়, সপুরায় অবস্থিত বিসিকে ২০০টি কারখানার মধ্যে ১৫টি বন্ধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো একসময় উৎপাদন করলেও এখন নানা কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ রেখে, সেসব জমি অন্যেকে অবৈধভাবে ভাড়া দিয়েছে।
একসময় খুবই রমরমা ব্যবসা ছিল রাজশাহীর সপুরায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প- বিসিক নগরীতে মেসার্স হক রাইস মিলের যা ১৪ হাজার ৪৫১ বর্গফুট জায়গার ওপর স্থাপিত। এ মিল থেকে উত্তরবঙ্গে চাল সরবরাহ হতো। বড় আকারের ঋণ থাকায় ২০১৭ সালে মিলটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন মালিকপক্ষ। তবে মিল বন্ধ থাকলেও মালিকপক্ষ জায়গাটি বিসিকের কাছে ছাড়েননি। বরং মিলটির একপাশে ২৫টি ছোট ছোট রুম তৈরি করে ভাড়া দেয়া হয়েছে বিভিন্ন লোকের কাছে। মিলটির ফ্লোর ভাড়া নিয়ে দুটি ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠান ব্যবসাও করছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, শুরুতে বিসিক শিল্পনগরীতে প্লট বরাদ্দ নিয়ে কারখানা করে উৎপাদনে গেলেও, অনেক কর্তৃপক্ষই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কারখানা বন্ধ রেখেছে। অনেকে আবার অবৈধভাবে অন্য কোনো ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দিয়েছে। বিসিকে ভাড়া নিয়ে অবৈধভাবে মানুষজন যেমন থাকছেন, তেমনি ভাড়া দেয়া হয়েছে লন্ড্রির দোকান, ফার্নিচার, কাঠ চেরাই মিল ও মসলার দোকান। অনেকে ব্যবসার ধরন পরিবর্তন করে ব্যবসা করছেন। তবে যেসব প্লটের মালিক এসব অবৈধ কাজের সঙ্গে যুক্ত তাদের কারখানার সামনে কোনো সাইনবোর্ড নেই। এজন্য সেসব কারখানা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীর শিল্প কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম জানান, এখানে প্রতি বর্গফুটে মাত্র সাড়ে ৩ টাকা সার্ভিস চার্জ হলেও অনেকেই সার্ভিস চার্জ ঠিকমতো দেয় না। বিশেষ করে যাদের কারখানা বন্ধ তারা কোনো সার্ভিস চার্জ দেন না। কয়েকটা প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় ৪ কোটি টাকার মতো সার্ভিস চার্জ বকেয়া রয়েছে।
মেসার্স হক রাইস মিলটিতে বাড়িভাড়া নিয়ে বসবাসরত উজ্জ্বল নামের একজন জানান, তিনি মাসিক ৩ হাজার টাকা ভাড়া নিয়ে এখানে থাকেন। অন্যান্য জায়গার তুলনার কম ভাড়া হওয়ায় এখানে থাকেন বলে জানান তিনি।
রাইস মিলটিতে উজ্জ্বলের মতো প্রায় অর্ধশতাধিক পরিবার ভাড়া থাকে। মিলটির পেছনের সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে টানা প্রায় ২৫টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। সেখানে শতাধিক লোকজন ভাড়া থাকেন। বাসাভাড়া থেকেই মালিকের প্রায় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ভাড়া আসে।
এছাড়া মাসিক ১৩ হাজার টাকায় রাইস মিলটির চাতাল ভাড়া নিয়ে একবছর ধরে প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ভাঙা জিনিসপত্র প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবসা করছেন মো. সুমন নামের একজন। এছাড়া আব্দুল ওয়াদুদ হাজি নামের একজন দুটি গুদাম ভাড়া নিয়ে পাটের বস্তার কারখানা স্থাপন করে ব্যবসা করছেন। তিনি চার বছর ধরে মাসিক ৭ হাজার টাকা ভাড়াতে জায়গাটি নিয়েছেন।
মেসার্স হক রাইস মিলের ম্যানেজার তরুণ কুমার জানান, ক্লাসিফায়েডের কারণে ২০১৭ সাল থেকে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এবি ব্যাংক প্রায় ২৫ কোটি টাকার মতো মিলটির মালিকদের কাছ থেকে পাবে। এ বিষয়ে আদালতে একটি মামলা চলমান আছে। তিনি জানান, মালিক পক্ষ জায়গাটি বিক্রির চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভালো কাস্টমার না পাওয়ায় তারা বিক্রি করতে পারছেন না। মালিকপক্ষ জায়গাটির ৩০ কোটি টাকা দাম চায়।
বিসিকের তথ্যমতে, রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরী-১ এর জমির পরিমাণ ৯৬ একর বা ৪১ লাখ ৮১ হাজার ৭৫৯.৫৬ বর্গফুট। এর মধ্যে মেসার্স কেরামত রাইস ও আটামিল ১৮ হাজার ৬০৪ বর্গফুটের প্লট নিলেও সেখান থেকে উৎপাদন না করে অবৈধভাবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। চাতাল ভাড়া দেয়া হয়েছে বিসমিল্লাহ প্লাস্টিক কারখানাকে এবং একটি তেলের কারখানাকে। এছাড়া রাইস মিল কর্তৃপক্ষ সেখানে দোতলা বাড়ি তৈরি করে বসবাসও করছেন।
এছাড়া মেসার্স বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের দুটি প্লট থাকলেও একটিতে তাদের কারখানা রয়েছে। অন্য প্লটটি কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে ভাড়া দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে ফার্নিচার শোরুম, মসলার দোকান, কাঠ চিরাই মিল ও ঝুট কাপড়ের গুদামঘর, যার তথ্য বিসিকের কাছে নেই।
বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের কাছে ভাড়া নেয়া ফার্নিচার ব্যবসায়ী মুনজুর রহমান জানান, তিনি বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের কাছ থেকে তিন মাস ধরে মাসিক ১০ হাজার টাকায় এই ঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন।
সেখানেই গুদামঘর ভাড়া নিয়েছেন মেসার্স বিএম এন্টারপ্রাইজ। পুরাতন কাপড়ের ব্যবসা করা বিএম এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার তুহিন আলী জানান, তারা ৯ বছর ধরে এই গুদামঘর ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করছেন। তবে কত টাকা ভাড়া দেয়া হয় তা তিনি জানাননি।
বিশাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার ফয়সল বিন মাহবুব জানান, তাদের এই প্লটটিতে অন্য ব্যবসা করার চিন্তাভাবনা ছিল। কিন্তু ব্যবসার ধীরগতির কারণে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য ভাড়া দেয়া হয়েছে।
অন্যদিকে মেসার্স নূর হাবিব গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজ (৭৮ হাজার ৫০০ বর্গফুট) গত কয়েক বছর ধরে বন্ধ। তাদের দুটি গুদামের একটি ৫০ হাজার, আরেকটি ১৫ হাজার টাকাতে ভাড়া দেয়া হয়েছে। প্লটে তাদের ফ্লাওয়ার মিল আছে, সেটাও তারা ভাড়া দিতে চায়।
মেসার্স নূর হাবিব গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার আলহাজ ফারুক শাহ্ জানান, ‘কাস্টমারদেরকে প্রচুর পরিমাণে বাকিতে পণ্য দেয়ার পর তা আর রিকভারি করা সম্ভব হয়নি। আমরা যেহেতু চাইনি লোন করে বিজনেসটা কন্টিনিউ করতে, তাই ফ্লাওয়ার মিলও ভাড়া দেয়া হবে। এছাড়া গ্রেইন ইন্ডাস্ট্রিজের দুটি গুদাম ও চাতাল ভাড়া দেয়া আছে।’
রাজশাহী বিসিক শিল্পনগরীর শিল্প কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম জানান, ‘বিসিকে আমাদেরকে না জানিয়ে অনেকেই অবৈধভাবে তাদের প্লট অন্যের কাছে ভাড়া দিয়েছে। আমরা সেগুলোর তালিকা তৈরি করছি। এছাড়া বেশ কয়েকটি বন্ধ থাকা প্লট হস্তান্তর করার প্রক্রিয়া চলছে। সেজন্য বন্ধ তালিকায় সেসব নাম দেয়া হয়নি।’ এখানে ১০টা পরিবার নিজের প্লটে বাড়ি তৈরি করে অবৈধভাবে বসবাস করতো। তাদের মধ্যে কয়েকটা পরিবারকে তুলে দেয়া হয়েছে। এখনও কয়েকটা পরিবার বসবাস করছেন তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতেও জেলা প্রশাসকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
আনোয়ারুল আজিম আরও বলেন, অনেক উদ্যোক্তা আছেন যারা প্লট চান কিন্তু আমরা তাদের প্লট দিতে পারি না। অথচ অনেকেই প্লট বন্ধ রেখে ভাড়া দিয়ে রাখছেন।
এজি প্লাস্টিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রোপাইটার আব্দুল গণি জানান, আমাদের কারখানা যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তাতে আরও একটি প্লট পেলে আমার ব্যবসা করা সুবিধা হতো। কিন্তু প্লট না পাওয়ায় কষ্ট করেই ব্যবসা করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে রাজশাহীর পবা উপজেলার দারুশা এলাকায় স্থাপিত বিসিক শিল্পনগরী-২ এর পরিকল্পনা নেয়া হয় ২০১৯ সালে। প্রায় ৫০ একর জমিতে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হলেও এখনও কার্যকর উৎপাদন শুরু হয়নি। মূল সমস্যা যেগুলো উদ্যোক্তারা চিহ্নিত করেছেন তা হলো, প্রাথমিক অবকাঠামো নির্মিত হলেও বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগে ঘাটতি। বিনিয়োগকারীদের অনাগ্রহ, প্লট বরাদ্দ প্রক্রিয়ার ধীরগতি। তাছাড়া রয়েছে সরকারি পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা।
উদ্যোক্তাদের আক্ষেপ, তাদের ব্যসসার আগ্রহ কি করে হবে? এজি প্লাস্টিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক আব্দুল গণি বলেন, আরও একটি প্লট পেলে ব্যবসা বাড়ানো যেত, কিন্তু আবেদন করেও প্লট পাইনি। পুরাতন বিসিকে বহু প্লট বন্ধ থাকা সত্ত্বেও নতুন উদ্যোক্তারা সুযোগ পাচ্ছেন না। তাছাড়া এর প্লটের ডে মূল্য তা রাজশাহীর বিবেচনায় অনেক বেশি।
রাজশাহীর বিসিক শিল্প নগরীগুলোতে একদিকে পড়ে রয়েছে বন্ধ মিল, অন্যদিকে প্লট চেয়ে ফিরছেন উদ্যোক্তারা। প্রশাসনিক দুর্বলতা, অবৈধ ভাড়া বাণিজ্য ও দীর্ঘসূত্রতায় রাজশাহীর শিল্প সম্ভাবনা আজ বাধাগ্রস্ত। দ্রুত নীতিমালা হালনাগাদ, কার্যকর নজরদারি ও প্লট পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ করে দিলে বিসিক পুনরুজ্জীবন সম্ভব। শুধু পরিকল্পনা নয়, চাই বাস্তবায়নের সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা।
এনিয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট মাসুদুর রহমান রিংকু জানান, বিসিকের সমস্যা নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেছি, তবে এনিয়ে তেমন অগ্রগতি দেখিনি। আমাদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুপারিশ ও পরামর্শ দেয়া হয়েছে তা অবশ্যই ব্যবসা স্বার্থকে উন্নত করার জন্যে। আশা করি এগুলোর সমাধান হবে।

Discussion about this post