অশোক দত্ত : দেশের রাজনীতি যেমন অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, শিক্ষাঙ্গনও যেন তার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজÑসব জায়গায় আন্দোলন, সংঘর্ষ, অবরোধ আর প্রশাসনিক অচলাবস্থার চিত্র এখন নিত্যদিনের ঘটনা। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের দাবির সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন এবং প্রশাসনের সিদ্ধান্তহীনতা মিলে তৈরি হয়েছে এক জটিল পরিস্থিতি। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে শিক্ষা কার্যক্রমে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজš§। সাম্প্রতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অস্থিরতা ঘিরে সার্বক্ষণিক নজরদারি চালাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রতি পরিণত হয়েছে সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে। স্থানীয় গ্রামবাসীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন উপ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ অন্তত ১৮০ শিক্ষার্থী। স্থানীয়দের পক্ষ থেকেও আহত হওয়ার অভিযোগ এসেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এ ঘটনার পর জেলা প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ও স্থানীয় জনগণকে নিয়ে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সব পক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়, যার লক্ষ্য শিক্ষার্থী ও স্থানীয় জনগণের সম্পর্ক পুনর্গঠন এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
অন্যদিকে, ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তিন দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যসহ প্রায় দুই শতাধিক শিক্ষককে অবরুদ্ধ করে রাখে। একই দিনে দু’বার ট্রেন অবরোধ করা হয় এবং রাতে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় ক্যাম্পাস সাময়িকভাবে বন্ধ করে আবাসিক হল খালি করার নির্দেশ দিলেও শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে অনড় রয়েছে। তারা জানিয়েছে, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
চট্টগ্রাম ও বাকৃবির বাইরেও দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিরতায় কাঁপছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ করে সংঘর্ষ ও ভাঙচুর হয়েছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জমি অধিগ্রহণ, পরিবহন সংস্কার ও ফিজিবিলিটি স্টাডি দ্রুত শেষ করার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে মহাসড়ক অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে। বুয়েটে বিএসসি ও ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের আন্দোলনের কারণে ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হয়ে পড়েছে, অচলাবস্থা বিরাজ করছে বিভিন্ন পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটেও।
তথ্য বলছে, গত এক বছরে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২৬টি সংঘর্ষ, ৯টি বড় আন্দোলন এবং ৩টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজ মিলিয়ে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা অন্তত ১২০টি আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। বিশেষভাবে আলোচিত ছিল ২০২৪ সালে সচিবালয়ে প্রবেশ করে শিক্ষার্থীদের এইচএসসি পরীক্ষার ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা স্থগিত করানো ও অটোপাস আদায়ের দাবি। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালেও শিক্ষার্থীরা অটোপাস দাবি তোলে, যদিও সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ঘনঘন সংঘর্ষ ও আন্দোলনের কারণে শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়ছে। প্রশাসনের প্রতি শিক্ষার্থীদের অনাস্থা দিন দিন বাড়ছে। অনেক ক্ষেত্রে উপাচার্য বা প্রশাসনিক প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করার চেষ্টা হয়েছে। কেউ পদত্যাগে রাজি না হলে তাকে অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে প্রশাসনিক জটিলতা আরও তীব্র হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে সংকটে ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কেবল চট্টগ্রাম বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরাপদ ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বিদ্যমান সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর সমাধানের প্রস্তাব দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তবে শিক্ষাবিদদের অভিযোগ, সরকারের পদক্ষেপ অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে থাকে অর্থাৎ সমস্যা তৈরি হওয়ার পর তাৎক্ষণিক সমাধানের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু টেকসই সংস্কার ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে ধারাবাহিক উদ্যোগের অভাব রয়েছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষাঙ্গনের বর্তমান অস্থিরতার পেছনে প্রশাসনিক অদক্ষতা, শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশা ও অসন্তোষ এবং স্থানীয় রাজনীতি ও সামাজিক টানাপোড়েন বড় ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রের সামগ্রিক রাজনৈতিক অস্থিরতাও শিক্ষাঙ্গনে প্রতিফলিত হচ্ছে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনে নামছে, কিন্তু তা সংঘর্ষে রূপ নিচ্ছে এবং শিক্ষার মূল লক্ষ্যকে ব্যাহত করছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সমন্বিত উদ্যোগের বাইরে বিকল্প কোনো পথ নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রশাসন ও স্থানীয় জনগণকে নিয়ে স্থায়ী সংকট ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা যেতে পারে। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার মৌলিক কাঠামোগত সংস্কার, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ জরুরি। না হলে চলমান অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে উচ্চশিক্ষার ভিত্তিকে দুর্বল করে দেবে।
শিক্ষাঙ্গন একটি দেশের ভবিষ্যৎ প্রজš§ গঠনের ক্ষেত্র। সেখানে যখন সংঘর্ষ, অবরোধ ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার চিত্র বারবার সামনে আসে, তখন শুধু শিক্ষার্থী নয়, গোটা জাতিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বাকৃবি, বুয়েট কিংবা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়Ñসব শিক্ষাঙ্গনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবি। সরকারের উচিত তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ামূলক পদক্ষেপের বাইরে গিয়ে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার নিশ্চিত করা। না হলে শিক্ষাঙ্গনের এ অস্থিরতা গোটা সমাজকে এক নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দেবে।

Discussion about this post